এমন সাজা দরকার ছিল : দিয়ার বাবা

0
70

বাংলা খবর ডেস্ক: রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর নিহতের মামলায় জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালকসহ তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মালিক জাহাঙ্গীর আলম ও হেলপার এনায়েতকে খালাস দেন আদালত।

রোববার (১ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং তাদের সহকারী কাজী আসাদ (পলাতক)।

এদিকে রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন মামলার বাদী নিহত দিয়া খানম মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম কালু। রায়ের পর তিনি বলেন, আমিও তো ড্রাইভার। ১৭ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। আমার দ্বারা তো কখনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। জাবালে নূরের দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন ছিলেন অদক্ষ ড্রাইভার। তারা ড্রাইভার নামে কলঙ্ক। তাদের সাজা পাওয়া উচিত ছিল। আদালত তাদের যাবজ্জীবন দেয়ায় আমি ও আমার পরিবার অনেক খুশি।

তিনি আরও বলেন, চালকের অদক্ষতার কারণে আজ আমি সন্তানহারা। রাস্তায় রাস্তায় কান্না করে ঘুরছি। কোনো মালিক যেন কখনো অদক্ষ ড্রাইভারদের গাড়ি চালাতে না দেন। মালিকদের প্রতি আমার অনুরোধ রইলো। আজ আমি আদালতের রায়ে অনেক খুশি।

এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে সাংবাদিকদের প্রতি বিচারক ইমরুল কায়েশ বলেছেন, এ মামলাটি পেনালকোডের ৩০৪ ধারায় হয়েছে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়ার সুযোগ নেই। আপনারা সংবাদগুলো এমনভাবে প্রচার করবেন যাতে ছাত্রসমাজ ও জনগণের মধ্যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি না থাকে।

আদালত বলেন, পরিবহন সেক্টরে অনেক খামখেয়ালিপনা দেখা যায়। বাসের বেপরোয়া চলাচলের কারণে চাকার নিচে পিষ্ট হওয়া থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরাও। এ ঘটনায় ট্রাফিক পুলিশকে সচেতন হতে হবে। মালিকরা চালকদের একটা নির্দিষ্ট জমা টাকা টার্গেট দেন। যেটা তাদের জটিল হয়। এ কারণে মালিকদের খুশি করতে বেপরোয়া চালায়। মালিকদেরও সচেতন হতে হবে।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে এমন অপরাধে ছাড় নেই। কেউ এ ধরনের অপরাধ করে পার পাবে না। এ রায়ের মাধ্যমে আরও প্রমাণ হয়েছে, এ ধরনের অন্যায়ের শিকার হয়ে আদালতে প্রতিকার পাওয়া যায়।

মামলায় দুজনের খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করা হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা রায় পড়ব এবং বিশ্লেষণ করব। রায় পড়া শেষে আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। তবে সার্বিকভাবে রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।

তবে এ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। একই সঙ্গে তারা উচ্চ আদালতে আপিলের কথা জানিয়েছেন। রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বাসচালক মাসুম বিল্লাহর আইনজীবী হাসিম উদ্দিন বলেন, রায়ে আমরা অবশ্যই অসন্তুষ্ট। ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাদের সন্তুষ্ট করতে আদালত এ রায় দিয়েছেন।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় কোনো চাক্ষুস সাক্ষী পাওয়া যায়নি। শুধু আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির প্রেক্ষিতে এ রায় দেয়া হয়েছে। রায়ের কাগজ পেলে বিষয়গুলো বুঝতে পারব। আমরা উচ্চ আদালতে যাব, আশা করছি উচ্চ আদালতে গেলে আমরা ন্যায়বিচার পাব। দুর্ঘটনাস্থলের কাছেই বাসস্ট্যান্ড থাকা সত্ত্বেও ফ্লাইওভারের গোড়ায় ছাত্ররা জোর করে বাস থামাত। সেদিনও সম্ভবত এমন কিছু ঘটেছিল, যেখানে বাসের চালক কোনোভাবেই দায়ী নয়।

যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক বাসচালক জুবায়ের সুমনের আইনজীবী টি এম আসাদুল হক বলেন, আমরা ন্যায়বিচার পাইনি, অবশ্যই আমরা উচ্চ আদালতে যাব। সাক্ষ্যপ্রমাণে বলা হয়েছে, আমার মক্কেল জুবায়ের সুমনের গাড়িটি চলমান ছিল। পেছন থেকে অন্য একটি গাড়ি তার গাড়িটি ধাক্কা দেয়। তার গাড়ি দ্বারা কোনো হতাহতের ঘটনা হয়নি। আসামিকে যাবজ্জীবন দিতে হলে মৃত্যুর কারণ প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু সুমনের গাড়ি দ্বারা কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে বাসচাপায় নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম।

ঘটনার দিনই নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী শরিফুল ইসলাম অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেন। ২৫ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েশ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ঘটনার দিন দুপুরে চালক ও তাদের সহকারীরা বেশি লোক ওঠানোর লোভে যাত্রীদের কথা না শুনে এবং তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে জিল্লুর রহমান উড়াল সড়কের ঢালের সামনে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়ান। এ সময় আরেকটি বাসের চালক মাসুম বিল্লাহ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪-১৫ শিক্ষার্থীর ওপর গাড়িটি উঠিয়ে দেন। ঘটনাস্থলেই দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। আহত হন আরও ৯ জন।

রাজীব-দিয়ার নির্মম ওই মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা শহরের প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করেন তারা। এমনকি কীভাবে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে হয় সেটিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তারা। ওই সময় শিক্ষার্থীদের দাবির অন্যতম ছিল- বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যাকারী চালকের ফাঁসির দাবি, সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চলা, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করা।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন বিল-২০১৮ পাস হয়। পাসকৃত আইনে সড়কে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে’ প্রাণহানি ঘটালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এছাড়া কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এক বছর আগে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস হলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অবশেষে গত ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’। যদিও আইনটি পুরোপুরি কার্যকরের আগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here