চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও রোবোটাত্মার শুদ্ধি

0
81

বাংলা খবর ডেস্ক: জেমস ওয়াট ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। বাষ্পীয় ইঞ্জিন সূচনা করেছিল প্রথম শিল্পবিপ্লবের। মাইকেল ফ্যারাডের ১৮৭০ সালের বিদ্যুৎ আবিষ্কার ছিল দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সূচনা। আর ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার সংঘটিত করেছে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের।

আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনায় আঙ্কিক তথ্যকে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রোবোটিক্সের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ডাক দিয়েছে।

বর্তমানে গুগলে দৈনিক ৪২০ কোটিবার বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয় বিভিন্ন ঠিকানায়। এগুলো বিশ্বব্যাংকের দেয়া হিসাবে। মানুষ দিনরাত নানা আঙ্কিক তথ্যের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির তরঙ্গের মধ্যে নিত্য ভেসে-ডুবে বিরাজ করছে মানুষের দৈনন্দিন কাজ কারবার, আশা-ভরসা সবকিছু। সারা বিশ্বের সব তথ্য এখন মানুষের হাতের মুঠোয়, চোখের তারায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষের সার্বিক জীবনযাপনে এসেছে এক বিস্ময়কর বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ছোঁয়া সূচিত করেছে ডিজিটাল বিপ্লব বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।

যে কোনো বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের পক্ষে থাকে অনুসন্ধিৎসু ও জ্ঞানপিপাসু একদল আধুনিক মানুষ। ডিজিটাল বিপ্লব ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে আধুনিক শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মানুষ নিজেদের অজান্তেই আপন করে নিয়েছে। ফলে এর বিপক্ষে সমালোচনা কম।

তদুপরি এর ব্যবহার কৌশল ও নেপথ্য বিষয়গুলো সব শ্রেণির মানুষ একসঙ্গে রপ্ত করতে অপারগ বিধায় প্রতিনিয়ত নানা অজানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে মানুষকে।

দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের পর উৎপাদন বেড়ে গিয়ে পরিবেশের ওপর যে ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব মানবসভ্যতাকে ভোগাতে শুরু করেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে নরম্যাটিভ ইকোনমি ও সাম্যবণ্টন ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাতছানিতে সারা বিশ্বে যে হইচই শুরু হয়েছে, তার ফলে দিকে দিকে যান্ত্রিক নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

আগে শোনা যেত সভ্য নামধারী উন্নত দেশে এক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ চলে গেলে শপিং মলে লুটতরাজ শুরু হয়ে যেত। অথবা পকেটে টাকা না থাকলে খাবার কিনতে না পরে কেউ কেউ উঁচু ভবন থেকে নিচে লাফিয়ে আত্মহত্যা করতে কুণ্ঠিত হতো না।

এগুলো ছিল অতি যান্ত্রিকতাপূর্ণ সমাজের মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা ও পারস্পরিক আস্থাহীনতার কুফল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাতছানিতে দেশে দেশে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিকতা আরও বেশি ঘনীভূত হয়ে পড়েছে। এখন শুরু হয়েছে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার নতুন অধ্যায়। এর ফলে শুরু হয়েছে চারদিকে নজরদারি ক্যামেরা বসানো।

মানুষের প্রতি মানুষের মনোযোগ কমে গিয়ে তা ঠেকেছে যন্ত্রের ওপর নির্ভরতায়। মানুষের নিরাপত্তাহীনতা কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। মানব জন্ম, প্রতিপালন, চিকিৎসা, বেঁচে থাকার দায়িত্ব এখন যন্ত্রের ওপর বর্তেছে।

ডাক্তারের চেয়ে কম্পিউটার বেশি ভালো চিকিৎসাসেবা দিতে পারে- এ বিশ্বাস মানুষের মধ্যে জন্মে গেছে। এ বিশ্বাস আরও বেশি ঘনীভূত হলে রেডিওলজিস্টরা একদিন চাকরি হারিয়ে ফেলতে পারেন।

এখন জিন সম্পাদনা চরম উৎকর্ষ সাধন করেছে; যা নিত্যনতুন নৈতিকতাহীনতার জন্ম দিয়েছে। জিন সম্পাদনার ফলে নারী-পুরুষের সংখ্যাগত যে জেনেটিক বৈষম্য সংঘটিত করে চলেছে, তা রীতিমতো ভীতিপ্রদ। ভারতে ছেলেসন্তান নেয়ার আকর্ষণের কারণে নারী-শিশু ভ্রূণ ধ্বংস করানোর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।

অপরদিকে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের হারও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশেও ঘোষণা এসেছে নারীবান্ধব শহর তৈরির। এ জন্য রাস্তায় রাস্তায় সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এতে নারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তাহানি ও চলাফেরা আরও বেশি সংকুচিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এভাবে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মূল্যবোধের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে দিচ্ছে মানব তৈরি ডিজিটাল মেশিন। যান্ত্রিক নৈতিকতা নতুনভাবে শিখতে ও উপলব্ধি করতে যে সময় ও জ্ঞান দরকার, তা হঠাৎ করে সব শ্রেণির মানুষের জন্য একসঙ্গে আয়ত্ত করা কঠিন।

এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হলে চিরায়ত সামাজিক ও নৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে ন্যায়-অন্যায়বোধ কমে যাবে। মানুষের পাপবোধ কমে যাবে ও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হাতছানিতে রোবট রাজত্বের দৌরাত্ম্য ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়বে। চিরায়ত আর্ট-কৃষ্টি নেতিবাচকরূপে উপস্থাপিত হতে থাকলে নতুন শিল্প বিপুল অপকর্মের জন্ম দেবে। যেমন করেছে ইউটিউব ও সেখানে লাগামহীনভাবে পোস্টকৃত কুরুচিপূর্ণ ছবি ও ভিডিওগুলো।

ইউটিউবে অবৈধভাবে ছেড়ে দেয়া মানুষ ও জীবজন্তুর যৌনজীবনের ভিডিওগুলো মানবসভ্যতার সবচেয়ে ঘৃণিত দিকটি সবার সামনে ঘরে-বাইরে দিনরাত ন্যক্কারজনক উপস্থাপন করে কুৎসিত চেহারাকে প্রকাশ করছে।

দেশে দেশে সেটা যে কোনো ধরনের ফায়ারওয়াল বা বাধা ব্যতিরেকে মানুষ নির্দ্বিধায় অবলোকন করছে। চরম শয়তানির উলঙ্গ দিকটির বহিঃপ্রকাশ জেনেও মানুষ এটাকে ডিজিটাল মূল্যবোধ হিসেবে মেনে নিয়ে আত্মার শুদ্ধি নষ্ট করছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে কর্মহীন হবে বহু মানুষ। ড্রাইভারবিহীন গাড়ি চালু হলে কাজ হারাবে কম শিক্ষিত লাখ লাখ মানুষ। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, খোদ আমেরিকায় বাসচালকরা কম শিক্ষিত। রোবটরা শ্রমিক হলে শ্রমিক ইউনিয়ন থাকবে না। কারণ, রোবটের কাছে চাঁদা তুলবে কে? এ ছাড়া রোবটের একটি ভুলের মাশুল দেবে কে?

সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে, সম্প্রতি মিয়ানমারে এক সফরের পর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নাম ফেসবুকে বার্মিজ ভাষা থেকে ইংরেজিতে ভুলভাবে অটো অনূদিত হয়ে অশালীন ভাষা হিসেবে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গিয়ে এক লজ্জাজনক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।

সেখানে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নাম অশ্লীলভাবে ‘মি. শিটহোল’ বা ‘জনাব মলভর্তি গর্ত’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে রোবোটিক অটো অনুবাদ মেশিনের সফটওয়্যার ত্র“টির কারণে!

ধরে নেয়া যাক এটা রোবটের ভুল- রাজনৈতিক কোনো ভুল নয়। এটাকে মানুষের ভুল বা মেশিনের জন্য মানুষের প্রতি মানুষের উদাসীনতা ও চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যদি রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য নেতিবাচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা হবে মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

তবে এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা ডিজিটাল বিপ্লবের ক্রিয়াকলাপ যতটুকু শুরু হয়েছে তার প্রভাবে কিছু মানুষের আয়, জৌলুস ও বিলাসিতা বেড়ে গেলেও সিংহভাগ মানুষের অলসতা, লোভ ইত্যাদি বেড়ে গেছে। অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, দান-খয়রাত করা, অপরের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া যেন মানুষ ক্রমান্বয়ে ভুলতে বসেছে।

মানুষের আত্মাগুলো যেন রোবটের আত্মা হয়ে উঠছে! মানুষের নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধে চরম ধস নেমে এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক ব্যবহার ও তার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে মানুষের প্রাকৃতিক মেধা নিঃশেষ হয়ে যাবে।

এর ফলে খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা এবং পাপবোধ আরও কমে গেলে মানুষ তার ‘লজ্জা নামক ভূষণ’ হারিয়ে পশুদের কাতারে মিশে যেতে পারে। তখন মানুষ থেকে ‘মা’ ও ‘মানবতা’ হারিয়ে গিয়ে বেঁচে থাকাবস্থায়ই মানবাত্মার অপমৃত্যু ঘটবে এবং পরস্পরের মধ্যে হিংসা, হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ বেড়ে গিয়ে পৃথিবীটা চরমভাবে অশান্তিময় হয়ে উঠবে।

ড. মো. ফখরুল ইসলাম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান

fakrul@ru.ac.bd

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here