হাসন রাজাকে ভুল বুঝেছি

0
215


মোঃ জেহাদ উদ্দিন

একজন অত্যাচারী, নারীলোভী এবং ঠেলায় পড়ে শেষ বয়সে পথে আসা একজন জমিদার, আর সেই সাথে আকর্ষণীয় সঙ্গীত স্রষ্টা-মোটামুটি এ ধরনের একটি ছবিই আমার সামনে ভেসে আসত হাসন রাজা সম্পর্ক। এর কারণও ছিল। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় হাসন রাজা সম্পর্কে জানার সুযোগ আমরা পাইনি। তাঁর সম্পর্কে যতটুকু ধারণা অর্জন করতে পেরিছিলাম তা মূলত: বাংলাদেশে নির্মিতি হাসন রাজা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি যে, সেই চলচ্চিত্রে একদম উল্টোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে হাসন রাজাকে।
পরবর্তীতে যখন ইন্টারনেটের বিপ্লব সূচিত হল, যখন গুগলে সার্চ দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় সকল বিষয়েই কিছু কিছু ধারণা লাভ করা যায়, তখন হাসন রাজার উপর সংঘটিত হতে লাগল আরেক ধরনের অত্যাচার। গুগল সার্চ দিয়ে যে হাসন রাজাকে সচরাচর পাওয়া যায়, তা-ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একেবারে উল্টো হাসন রাজা। অর্থাৎ যা তিনি নন, সেই হাসন রাজা। সেই গদ বাঁধা কথা, অত্যাচারী, নারীলোভী, আরও কত কি…..!
হাসন রাজা সম্পর্কে এই অভিজ্ঞতা যে একা আমার, তা ভাববার কোন অবকাশ নেই। বরং অধিকাংশ মানুষের অভিজ্ঞতা আমার মতোই বলে আমি মনে করি।
আর সেই কারণেই সঙ্গীতের অমোঘ আকর্ষণে হাসন রাজার গানের কাছে ছুটে গেলেও ব্যক্তি হাসন রাজার কাছে যেতে মন চাইত না। কেমন যেন একটা নেতিবাচক চিত্রকল্প মনকে আচ্ছন্ন করে তুলত।
পরবর্তীতে বিশেষ কারণে হাসন রাজা সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ তৈরি হল। বলা যেতে পারে, অনেকটা বাধ্যবাধকতাই তৈরি হয়ে গেল। বলা যেতে পারে, বিষয়টি এসেছে অনেকটা অলৌকিকভাবেই।
আমার স্কুল পড়ুয়া ছেলে রাজিন শারাফি আমাকে হাসন রাজার দিকে টেনে নিল। কিভাবে নিল সেই বয়ান সুযোগ পেলে পড়ে কোন লেখায় করব।
ওর প্রচণ্ড আগ্রহের কারণে একদিন ওকে নিয়ে আমি ঢাকা থেকে ছুটলাম সুনামগঞ্জে। সেখানে গিয়ে সামারীন দেওয়ানের সাথে একটি অবিচ্ছেদ্য বন্ধন গড়ে তুললাম। সামারীন দেওয়ান হলেন সুনামগঞ্জে হাসন রাজা মিউজিয়াম ট্রাস্টের প্রধান। তিনি হাসন রাজার চতুর্থ ছেলের নাতি। হাসন রাজার শোনিত ধারা সরাসরি প্রবাহিত হচ্ছে তাঁর মধ্যে।
হাসন রাজার প্রপৌত্র হিসেবে নয়, বরং একজন হাসন গবেষক হিসেবে সামারীন দেওয়ান আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছেন। গতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ আমাদের অজ্ঞতা, অবহেলা, অযত্ন কিংবা দুশ্চরিত্রপনার কারণে মরমি সাধক হাসন রাজার নিস্কলুষ চরিত্রের উপর যেসব অযাচিত ময়লা আবর্জনা আপতিত হয়েছে, তিনি অতি যত্ন সহকারে, তথ্য-প্রমাণযোগে এবং সর্বোপরি হাসন রাজার জীবন ও সৃষ্টি-কর্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, সেই সব ময়লা-আবর্জনা দূর করার কাজটি করে যাচ্ছেন। অবশ্য যারা হাসন রাজাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কাজ তিনি করেন না। বরং সত্যিকারের হাসন রাজাকে তিনি নীরবে নিভৃতে তুলে ধরে চলছেন। তাঁর বিশ্বাস, সত্য সমাগত হলে মিথ্যা এমনিতেই বিদূরিত হয়ে যাবে।
আমার এ যাবতকালের অল্প বিস্তর পড়াশোনা এবং তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় আমি নিশ্চিত হয়েছি, চলচ্চিত্রে হাসন রাজাকে একেবারে উল্টেভাবে, ন্যাক্কারজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর গুগলে সার্চ দিয়েও যে হাসন রাজাকে পাওয়া যায়, তা-ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তিকর।
বরং সত্যিকারের হাসন রাজা হলেন অন্যরকম উচ্চতার একজন সুমহান মরমি সাধক। ছোট বেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত ধীর-স্থির ও সত্যানুসন্ধানী। অত্যন্ত প্রজাবৎসল একজন জমিদার ছিলেন তিনি। ৫ লক্ষ একরেরও বেশি এলাকার বিরাট জমিদার ছিলেন তিনি। কিন্তু অত্যন্ত অমায়িক ও সাধাসিধা চরিত্রের একজন মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি প্রজাদের খাজনা মাফ করে দিতেন। এতে করে তাঁর জমিদারির একটি বড় অংশ ইংরেজরা নিলামে বিক্রি করে দেয়। এত বড় জমিদার হয়েও তিনি কোন ধরনের কোন বিলাসিতা করতেন না। ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতেন। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, কি ঘর বানাইমু আমি শুন্যের মাজার!’ স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। পরাক্রমশালী ইংরেজদের সামনে বুক ফুলিয়ে বলতেন, ‘হাসন রাজা বাঙ্গালী’। প্রজাসাধারণের কল্যাণে যা করেছেন সেই সবের ইয়ত্ত্বা নেই। অগণিত দাতব্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছেন, কিন্তু কোথাও নিজের নাম ব্যবহার করেননি। সুনামগঞ্জের আজকের জুবিলী স্কুল তাঁর তৈরি। কিন্তু নিজের নাম দেননি। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় তিনি সারারাত আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে থাকতেন। কেঁদে কেঁদে বলতেন, প্রভু, আমার জীবন নিয়ে আমার প্রজাদের রক্ষা কর।
এক হাজারে বেশি সঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাঁর এই সব সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা হলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে, তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, বরং গোটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মরমি সাধকদের একজন।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কয়েকটি গানের সন্ধান পেয়ে থমকে গিয়েছিলেন। এত বড় সাধক! এত বড় দার্শনিক! পরে তিনি বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে বিশ্ব সুফি সম্মেলনে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে হাসন রাজার দর্শন তুলে ধরেন।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হাসন রাজার প্রেমে পাগল ছিলেন। তাঁর চোখে হাসন রাজা ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকদের অন্যতম। একবার অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন:
‘আচ্ছা বলতে পার, তোমার নানা হাসন রাজার গানের ভাবটি দর্শন শাস্ত্রের অন্য কোথাও আবিস্কার করতে পেরেছ কি না! সেই যে তিনি বললেন: ‘মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন’ এরূপ কোন কথা তোমাদের কোন দার্শনিক তাঁর কানে বলেছিলেন?” (নজরুল ইসলামের সাহচর্যে: দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, নজরুল একাডেমী, ঢাকা)

এর মানে দার্শনিক হাসন রাজা অনন্য।

এভাবে হাসন-অধ্যয়নে যতই দিন যাচ্ছে, ততই আমার বিশ্বাসর পোক্ত হচ্ছে যে, হাসন রাজাকে আমি ভুল বুঝেছি। অবশ্য এর দায় আমার নয়। এর দায় আমার সমাজের, আমার শিক্ষা ব্যবস্থার।

সঠিক হাসন রাজাকে তুলে ধরার মানসে এটিএন বাংলায় হৃদয়ে হাসন রাজা নামে একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। আমি মনে করি, এই অনুষ্ঠানটি সকলের দেখা উচিত।

(ঢাকা: ৭ মে, ২০২০)

লেখক: নজরুল গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here