‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ১৩)

0
115

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(পর্ব- ১৩)

এবার আরেক নতুন উপসর্গ। থেকে যাওয়া আর নতুন আসা ঊর্ধ্বতন একজনের মধ্যে আবার জুটি। একসঙ্গে চলাফেরা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দ্বন্দ্ব, অফিসের সবাই বুঝতে পারেন। কিছু হলে দু’জনেই মালিকের কথা বলেন। এতে আবার পত্রিকার পরিবেশ কিছুটা অবনতি হতে থাকে। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার সুপারিশে চাকরি নিয়ে আসেন একজন। তার যেদিন চাকরি হয় সেদিন মালিক নিজের অফিসে আমাকে ডেকে নেন। এ সময় তাদের পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছিলেন। মালিক আমাকে বলেন, আপনাদের হয়তো লোকের দরকার নেই, তবুও একজনকে চাকরি দিতে হবে। আমি জানতে চাইলাম কে? তিনি নাম বললেন। আগেও তাকে দেখেছি যোগদানের জন্য চেষ্টা করতে। তখন বলেননি, এখন বলছেন কেন? জানতে চাইলে বলেন, সুপারিশ আছে। তার কথা রাখতে হবে। পদ-পদবি, বেতন ইত্যাদি ঠিক করে অফিসে ফিরে আমি আরেকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে জানালে তিনি বেশ মনঃক্ষুণœ হন। কিন্তু নতুন জন যোগদানের পরে কিছুদিনের মধ্যেই সাবেক ও নতুনের মধ্যে বেশ সখ্য লক্ষ্য করি। আগের দু’জন যেমন ছিলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের মধ্যেও একধরনের স্নায়ুযুদ্ধ লক্ষ্য করি। কিন্তু ওপরে ওপরে দু’জন ঠিক। শেষপর্যন্ত পরে যোগদেয়া ওই সাংবাদিকও থাকতে পারেননি। তাকেও পদত্যাগ করতে হয়েছে। আমি অবশ্য এর অনেক আগেই বাংলাদেশ প্রতিদিন ছাড়ি। তবে বাইরে থেকে যা শুনেছি তা হলো, আপাতদৃষ্টিতে সোজাসাপ্টা ও মেজাজি ওই সাংবাদিক কৌশলের কাছে মার খেয়েছেন। আমি যতটুকু শুনেছি, পদত্যাগের পর তিনি যে কারণ প্রকাশ করেছেন, আসল কারণ কিন্তু তা ছিল না। তিনি যাকে দায়ী করেছিলেন, পরে হয়তো ভুল বুঝতে পেরে তাকেই এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যান। আমার জানা মতে, এখনো তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।

শুধু সংবাদপত্র কেন সরকারি বেসরকারি অফিসেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা একধরনের স্নায়ুযুদ্ধ থাকে। আমাদের প্রতিষ্ঠানেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এর মধ্যেই সবাই কাজ করে। কাজ করতে হয়। মানিয়ে নেয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। কেউ মানিয়ে নিতে পারে, কেউ পারে না। দেখা গেছে যারা মানিয়ে নিতে পারেন না, তারাই ভোগান্তির শিকার হন। যারা মানিয়ে নিতে পারেন, জ্বি হুজুর, জ্বি হুজুর করেন, তারা হেসে খেলে সময় কাটিয়ে দেন। আর যদি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মলিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কারো সখ্য বা সুনজর থাকে তাহলে কাজ না করে ‘চাপাবাজি’ করেই চাকরির সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। এ ক্ষেত্রে কারণে-অকারণে মালিকের বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ঘুরঘুর করতে হয়। কাজ ফাঁকি দিতে বা বড়াতি কিছু সুযোগ নিতে নানা অভিযোগ, অনুযোগও বিভিন্ন জন সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলতে হয়। আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে এমনটি দেখেছি অনেক স্থানে। কিন্তু এ ধরনের লোকের কারো শেষ পরিণতি ভাল হতে দেখিনি। আমি যেখানেই কাজ করেছি, এমনকি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে চাকরিকালেও সবাইকে বলেছি, কর্মচারী কোনদিন মালিকের বন্ধু হয় না। সাময়িকভাবে কেউ কেউ কারণে-অকারণে পিছ পিছ ঘুরে সুবিধা নিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু মালিকরা মালিকই থাকেন। কর্মচারী কর্মচারীই। বরং এ ধরনের লোকের জন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়। অসত্যকে যারা সত্য বলে পার পেতে চান সাময়িকভাবে তারা সুবিধাভোগী হন। তবে একথাও সত্য যে, কেউ কেউ নিরলস শ্রম ও মেধা দিয়ে নির্মোহভাবে কাজ করে প্রতিষ্ঠানকে ওপরে তুলে ধরেন, সুনাম ছড়িয়ে দেন। তারা অন্তর্মুখী। এমনিতেই তাদের মূল্যায়ন হয়, প্রচার করতে হয় না। কিন্তু এ শ্রেণীর লোক যারা মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে বেশি বেশি ঘুরঘুর করেন না, তারা আবার ছিটকেও পড়েন। তবে তাদের চাকরির অভাব হয় না। অবশ্য কোনো কোনো সময় একজনের ভাল কাজের সুবিধাভোগী আরেকজন হয়ে ওঠেন। আমাদের সমাজে এমন নজিরের অভাব নেই।

এসব কিছুর মধ্যেও বাংলাদেশ প্রতিদিন ভাল চলছে। দিন দিন প্রচারসংখ্যা যেমন বাড়ছে ব্যবসাও বাড়ছে। মালিক-কর্তৃপক্ষও খুশি। আগেই বলেছি, সব প্রতিষ্ঠানেই নানা ধরনের জটিলতা থাকে। অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে। এসব মানিয়ে নিয়েই কাজ করতে হয়। চাকরি করতে হলে এসবের বিকল্প নেই। কিন্তু আমি মনে হয় সেই ধাঁচের বিপরীতে অবস্থান করছিলাম। কাগজ বড় হয়ে গেছে, নাম-ধাম সম্মানও অনেক। সুযোগ-সুবিধাও ভাল। কিন্তু কিছু কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় আমার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। শুধু সুযোগ-সুবিধাই কি মানুষের জন্য সবকিছু? আমি মনে করি ‘না’। তবে একথা বলে রাখা ভাল, মালিক-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার কখনো তেমন মতবিরোধ হয়নি। পত্রিকার প্রচার, চালুসহ যে কোন বিষয়ে আমি যা বলেছি মালিক পক্ষ কখনও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। কেননা তারা দেখছেন, পত্রিকা ভালভাবে চলছে। তাই মালিকপক্ষের কাছ থেকে যখন যা চেয়েছি তা পেয়েছি। তবে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হবে, একটি দৈনিক প্রত্রিকা এবং তার সম্পাদক সম্পর্কে বিরূপ প্রায় একই ধরনের একাধিক রিপোর্ট ছাপানোর বিষয়টি আমার পছন্দ ছিল না। কেননা ঘুরেফিরে প্রায় একই বিষয়ে কয়েকদিন পরপরই রিপোর্ট করা হতো। এ রিপোর্টগুলো ছাপার জন্য কর্তৃপক্ষীয় আদেশ আসত। নতুন কিছু হলে আমার আপত্তি থাকতো না। ঘুরেফিরে একই ধরণের খবর। আমি এ বিষয়ে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানায়, ওই পত্রিকাটি তাদের দুঃসময়ে তাদের বিরুদ্ধে অনেক রিপোর্ট করেছিলো। তাদের মতে ওই রিপোর্টগুলো সত্য ছিল না। এ সময় তারা আরেকটি দৈনিকের কথাও উল্লেখ করে। বসুন্ধরার মালিক স্পষ্টই জানান, সংবাদপত্রের ব্যবসায় তাদের আসার ইচ্ছা ছিল না। শুধু তাদের বিরুদ্ধে ওই পত্রিকা দু’টির লেখালেখির কারণে পত্রিকা বের করতে বাধ্য হন। একটি পত্রিকা ও তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে টানা নিউজ করার বিষয়টির সাথে আমি একমত হতে না পারলেও মালিক পক্ষের যুক্তির পর আমার বলার বা করার কিছু ছিল না। এছাড়াও আমার আপত্তি বা রক্তক্ষরণ ছিল মালিকের নাম ব্যবহার করে কারও কারও অতিরিক্ত খবরদারি। পত্রিকার স্বার্থে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে মালিককে এ-কথাগুলো আমি কখনও বলিনি। হজম করেছি। নিজ হাতেগড়া পত্রিকার কোন ক্ষতি হোক, কোন সময়ই চাইনি। বলতে গেলে বাংলাদেশ প্রতিদিন আমার সন্তানের মতো। নিজ সন্তানের কোন ক্ষতি কি কারো কাম্য হতে পারে? আর আমি দেখেছি, একই গ্র“পের আরেকটি কাগজ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রথম থেকেই আমি এ ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। তাই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়েই কাজ করেছিলাম। কিন্তু একদিনের একটি ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। প্রতিদিন বিকালে আমি সংবাদসংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করতাম। বৈঠকটি মূলত পরদিন পত্রিকায় কী কী নিউজ ছাপা হবে, কীভাবে ছাপা হবে ইত্যাদি নিয়ে। সেদিনও বৈঠকে বসেছি। বার্তা সম্পাদক যথারীতি দিনের নিউজের তালিকা আমার হাতে দিলেন।প্রতিদিনের মতো সবাই মিলে পরদিনের পত্রিকার পরিকল্পনা শুরু করি। এমন সময় নতুন যোগ দেয়া এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হঠাৎ করে আগের দিন ছাপা হওয়া একটি নিবন্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি জানতে চান এ নিবন্ধ কার অনুমতিতে ছাপা হয়েছে? আর লেখকের নামের বিশ্লেষণে ‘মহানায়ক’ কেন? আমি বিস্মিত। আমি সম্পাদক। পত্রিকায় যা ছাপা হয় দায় দায়িত্ব সম্পাদক হিসেবে আমার আর প্রকাশকের। আর পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি মেনে কোনো নিবন্ধ ছাপাতে সম্পাদককে কারো অনুমোদন নিতে হবে এটি কেমন কথা? এমনটিতো কখনও শুনতে হয়নি। আর নিবন্ধটি ছিলো একটি বিশেষ দিন উপলক্ষে লেখা। লিখেছেন একজন বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা। বর্তমানে মন্ত্রী। এসব দিবসে যার লেখা আনার জন্য অনেক পত্রিকার লোক গিয়ে বাসায় বসে থাকেন। আর আমরা বলতেই পেয়ে গেছি। গণঅভ্যুত্থানের ‘মহানায়ক’ হিসেবেই তিনি পরিচিত। তার এমন প্রশ্নে আমার মতো ওই বৈঠকে উপস্থিত অন্যরাও হতবাক। পত্রিকায় আমার পর যার অবস্থান ছিল তিনি বললেন, তার লেখাতো আমরা গিয়ে নিয়ে আসি। আর তিনিতো গণঅভ্যুত্থানের ‘মহানায়ক’ সবাই জানেন। সবাই লেখেন। নিবন্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ওই সাংবাদিক আরও কিছু বলতে চাইলে অন্যরা থামিয়ে দেন। আমি এই একদিন সম্পাদক হিসাবে নিজেকে অনেক অসহায় বোধ করেছি। আমার অবস্থান থেকে কোন অভিযোগ, অনুযোগ করা যথার্থ নয়। তাই সেদিন থেকে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণায় ছিলাম। তার এ-ধরনের ব্যবহারের কারণও জানার চেষ্টা করি। আমার জানা মতে, ওই নিবন্ধ লেখক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপানকারী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের ভাল সম্পর্কই ছিল। নিয়মিত ওই নেতার বাসায় যাতায়াত ইত্যাদি ছিল। পরে কোনো বিষয় নিয়ে হয়তো কোনো সমস্যা হতে পারে। যে কারণে ওরকম বিরূপভাব। আর অনেকদিন চাকরিহীন অবস্থায় থেকে হঠাৎ করে আগের চেয়ে ভাল বেতন, সুযোগ-সুবিধার চাকরি পেয়েও তিনি একটু বেপরোয়াই হয়ে থাকতে পারেন। তিনি ভাল রিপোর্টার ছিলেন। ভাল কলামিস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিনে চাকরি হওয়ার পর তার ব্যবহার, চাল-চলন পাল্টে যায়। কারণ ওই সাংবাদিক আগেও এক পত্রিকায় আমার সঙ্গে কাজ করেছে। তখন এমন দেখিনি। আর আমার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল চমৎকার। দারুণ আড্ডাবাজ। রোমান্টিক। কিন্তু হঠাৎ যেন বদলে যান মানুষটি। আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন ছেড়ে আসার পরও তার বেপরোয়া ভাব অব্যাহত থাকে বলে জেনেছি। মালিকপক্ষের সাথে সুসম্পর্কের দোহাই ছিল এর মূল কারণ। কিন্তু তিনিও বেশিদিন টিকলেন না। ভিতরে ভিতরে অনেকেই তার এত বেপরোয়া গতি মেনে নিতে পারেনি। লোকটি মেজাজী, তবে এতটা জটিল নয়। তার মেজাজের সুযোগ নেয় অন্যরা। আগেই বলেছি, মালিককে বন্ধু ভাবা ঠিক নয়। বন্ধু ভেবে সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু মালিক অবশ্যই তার প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখবেন। চাকরি করতে হলে কর্মচারী হয়েই কাজ করতে হবে। ওই সাংবাদিকের বেলায়ও তাই হয়েছে। যে কোন করণেই হোক তাকে পদত্যাগ করতে হয়। পদত্যাগের পর তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযুক্ত করেন ওই রাজনৈতিক নেতাকে। যার নিবন্ধ ছাপার জন্য সম্পাদককে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছিলেন। কিছুদিন ওই নেতার বিরুদ্ধে (বর্তমান মন্ত্রী) তার লেখালেখি, কথা-বার্তা চলে। পরে শুনেছি আবার তার কাছে গিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।

সেদিন আমার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়েছিল তাতে এমন একটি পরিবেশে চাকরি করা সম্ভব কি-না চিন্তাভাবনা করছিলাম। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় থেকেই সাংবাদিকতা শুরু করি। মাস্টার্স পাস করে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। একজন জুনিয়র রিপোর্টার থেকে সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক। মানুষের জীবনে আর কী চাই। মান-সম্মান, খ্যাতি সবই হয়েছে। তবে অর্থবিত্ত নেই, সঞ্চয়ও নেই। চাকরি করতেই হবে। চাকরি না থাকলে সংসার চলবে না। এমন একটি অবস্থায় দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। সারাজীবনের সাংবাদিকতায় নিজের পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছি। এ ঘটনাটি ছাড়াও আরও কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ঘটনা আমাকে নানাভাবে পীড়া দেয়। কিন্তু আমি কিছুতেই মালিকপক্ষকে কোনদিন এসব বিষয়ে জানাইনি। কারণ পত্রিকার সম্পাদক আমি। আমার পক্ষে অধস্তন কাউকে নিয়ে অভিযোগ মানায় না। আর শত সমস্যার মধ্যেও পত্রিকার কোন ক্ষতি হোক তা আমি চাইনি। আগেই বলেছি বিভিন্ন অফিসে এ ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জন্য অস্বাভাবিক। আমি মনে করেছি আমি নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। তাই আমাকে সামনে রেখে কারো কারো ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল ইত্যাদি মেনে নেয়া যায় না। তাই মনোব্যথা। সবার জন্য ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুগান্তরে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এছাড়াও প্রায় একই ধরনের অভ্যন্তরীণ সমসার সৃষ্টি হয়েছিল। এ-সবই ছিল যুগান্তর ছাড়ার কারণের মধ্যে অন্যতম। মনের মধ্যে যখন এমন টানাপড়েন, তখন একদিন আমার এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ফোন করে দেখা করতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম, আমি নিজেই তার অফিসে যাব। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চিকিৎসক। প্রথমে ছোট একটি ডায়াগনস্টিক দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন বড় হাসপাতাল, বড় ডায়াগনস্টিক। ল্যাবএইডের মালিক। ডা. এ এম শামীম। আমি যখন ইত্তেফাকে কাজ করি তখন তাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। সাবেক উপদেষ্টা। সেই থেকে মাঝে মধ্যেই যোগাযোগ হত। তার অনুরোধে অফিসে যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যেই ল্যাবএইড থেকে কফি পান করে গেছি। আমি যখন যুগান্তরে কাজ করি তখন তিনি প্রায়ই আমার সঙ্গে মিডিয়া নিয়ে আলোচনা করতেন। খুঁটিনাটি জানতে চাইতেন। মিডিয়ার প্রতি তার আগ্রহও ছিল বেশ।

একসময় শুনেছিলাম তিনি টিভি করতে চান। বিএনপি আমলে অনুমোদন পাওয়া একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিকানাও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। টিভিটি তখন অন্যরা নিয়ে যায়। বর্তমানে সম্প্রচারে আছে। এরপর নতুন টিভি চ্যানেল করারও চেষ্টা করেছেন। শ্রদ্ধাভাজন এবিএম মূসা সাহেবকেও তিনি টিভি চ্যানেল করার কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তাও পারেন নি। যেমন অনেকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন পেলেও তিনি এখনও পাননি। কেন পাননি তাকে আমি জিজ্ঞেস করিনি। অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি। তিনি প্রায়ই আমাকে ফোন করতেন। কথা হতো। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক হওয়ার পর তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন। একদিন তার অফিসে কথায় কথায় জানতে চান, ভাল একটি পত্রিকা করতে কত ব্যয় হতে পারে। আমি জানাই পত্রিকার বিষয়টি অন্যান্য ব্যবসার মতো নয়। নিদির্ষ্ট করে ব্যয়ের অংক বলা যাবে না। তবে র্ধৈয ধরে যারাই বিনিয়োগ করেছেন সে সব পত্রিকা ভাল বাজার পেয়েছে। আর ব্যবসাসফলও হয়েছে। আর যারা ছয়মাস, একবছর পর বেতন-ভাতা দিতে পারে না, সার্কুলেশন বেশি হলে কমিয়ে দেয়, ছাঁটাই করে, তাদের পত্রিকা চলেনি, ভবিষ্যতেও চলবে না। পত্রিকা করতে হলে ভাল স্টাফ, চাহিদামতো পত্রিকা সরবরাহ এবং কয়েকবছর অব্যাহত বিনিয়োগ করতে পারলে জনপ্রিয় ও লাভজনক করা সম্ভব। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম কেন, ইচ্ছা আছে কিনা। তিনি বললেন, চিন্তা করছি। আমি বললাম, নামলে বুঝে-শুনে নামবেন। এখনও আমার সাথে পত্রিকা প্রকাশ নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের একই কথা বলি। উৎসাহিত না করে বরং নিরুৎসাহিত করি। কেননা ঝোঁকের বশে অনেকে পত্রিকা প্রকাশ করে বেশি দিন চালান না। এতে সাংবাদিক কর্মচারী বেকার হন। সেদিন আর বেশি কথা হয়নি। তবে এরপর মাঝে মধ্যেই কথা হতো। তিনি প্রায় সবসময়ই পত্রিকার কথা বলতেন, ব্যক্তিগত অনেক বিষয় নিয়েও তার সাথে কথা হত। তার সঙ্গে একধরনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হওয়ায় মাঝে মধ্যে আমার কিছু মনোবেদনার কথাও বলতাম। এসব কোন সিরিয়াস আলোচনা ছিল না। পরিচিত, ঘনিষ্ঠজনরা আড্ডায় আলোচনায় ব্যক্তিগত, অফিসিয়াল ও পারিবারিক ছোটখাটো বিষয়েতো কথা বলেই থাকেন। আমাদেরও আলোচনা ছিল এরকম। কিন্তু তার ফোনের পরদিন অফিসে গেলে তিনি একটি ভাল বাংলা প্রত্রিকা প্রকাশ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, যদি আমি তার সাথে যোগ দেই তাহলেই পত্রিকা প্রকাশ করবেন। নইলে নয়। আমি জানতে চাইলাম আপনি বুঝে বলছেন, নাকি আবেগে। আগেই বলেছি সেদিন অফিসের ঘটনাটি কেন জানি আমার মনোপীড়ার কারণ হয়। এর একদিন পরই তার এ প্রস্তাবে আমি সম্মতি কিংবা অসম্মতি কিছু না জানিয়ে শুধু বললাম, আপনি চিন্তা করেন। আমি অফিসে চলে যাই। বিষয়টি নিয়ে আমি আর ভাবিনি। ব্যস্ত ছিলাম। ক’দিন পর আবার ল্যাবএইডের শামীম সাহেবের ফোন। তিনি আমাকে প্রতিদিন ছাড়ার বিষয়ে আমার কোন সিদ্ধান্ত জানতে চাইলেন না। একটা খবর জানালেন।তার বক্তব্যটি এমন, বসুন্ধরা গ্র“পের চেয়ারম্যান অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতিদিনের মালিক শাহ আলম সাহেব তাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিলেন। ফোনে জানতে চেয়েছেন তিনি যে পত্রিকা বের করবেন তাতে আমি যোগ দিচ্ছি কিনা? আমার সাথে কথা পাকাপাকি হয়েছে কিনা? তিনি কথাটা আমাকে এমনভাবে উপস্থাপন করেলেন যে, প্রতিদিনে এখন আমার পক্ষে কাজ করা কঠিন। শাহ আলম সাহেব সব জেনে গেছেন। আমি শান্তভাবে তার কাছে জানতে চাইলাম যা কিছু কথা হয়েছে আপনার আর আমার মধ্যে। আপনি পত্রিকা বের করতে চান। আমাকে যোগ দিতে বলেলেন, আমি তো আপনাকে কথা দেইনি। তাহলে শাহ আলম সাহেব জানলেন কী করে? তার তো জানার কথা না। তিনি বললেন, ভাই বসুন্ধরা গ্র“প তাদের কর্মকর্তা কর্মচারী সবার সম্পর্কে খরব রাখে। কে কোথায় যায় তাদের স্টাফ ইত্যাদি। আমার খটকা লাগলো। তবুও বললাম, ঠিক আছে কাল আপনার অফিসে আসব। এসে শুনব। এর মধ্যে আমার মনে বেশ একটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। কেননা শাহ আলম সাহেব প্রথমে আমাকে বসুন্ধরার উপদেষ্টা পরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক করেছেন। মালিক-কর্মচারীর মধ্যে যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে তা আমাদের আছে। আর তিনি মুখ ফুটে কোনদিন আমার কোন কাজ ও দায়িত্ব পালন নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করেননি। আর এমন করার কথাও ছিল না। পত্রিকা ভাল চলছে। তবে কেন তিনি এমনটি করবেন। আবার ভাবলাম ল্যাবএইডে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কত লোক আসে, কে কোথায় দেখেছে। এমন হতে পারে কেউ গিয়ে তাকে বলতে পারে। শামীম সাহেব মিডিয়া গড়তে চান এমন আলোচনা তো ছিলই। আমি ভাবলাম এমন অবিশ্বাস থাকলে কাজ করা কঠিন। বিশেষ করে আমাকে জিজ্ঞেস না করে সরাসরি শামীম সাহেবকে। এমন চিন্তাভাবনার মধ্যে পরদিন শামীম সাহেবের অফিসে যাই। আগের মত কফি এলো। কথা হলো। জানতে চাইলাম, আসলেই শাহ আলম সাহেব না অন্য কেউ ফোন করেছিলো। তিনি সিরিয়াসলি বললেন, শাহ আলম সাহেব। আমি মনে মনে ভাবলাম শাহ আলম সাহেবকে কি বিষয়টি জিজ্ঞেস করব? আবার ভাবি তিনি আমাকে কিছু না জানিয়ে যদি শামীম সাহেবকে ফোন করে থাকেন তাহলে আর জিজ্ঞেস করে লাভ কী? আর যদি ফোন না করে থাকেন তাহলে জিজ্ঞাসা করা মানে আরেক জটিলতা। তাই আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। এভাবে ক’দিন চলল। এর মধ্যে শাহ আলম সাহেবের সাথে অনেকবার দেখাও হয়েছে। কথা হয়েছে। তার কাছ থেকে এমন কোন ইঙ্গিত পাইনি। অফিসে ঊর্ধ্বতন যারা আছেন তাদের কাছ থেকেও কোনো ধরনের আভাস-ইঙ্গিত নেই। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একধরনের খটকা লাগছিলো। সর্বোচ্চ মেধা শ্রম ও সময় দিয়ে প্রতিদিনে কাজ করছি। কাগজ দিন দিন ভাল হচ্ছে। কেন এমন সন্দেহ?

দু’দিন পর আবার শামীম সাহেবের ফোন। এবার তিনি জানালেন, বসুন্ধরা থেকে কে জানি ফোন করে আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। অনেকদিন শামীম সাহেবের সাথে পরিচয়। তাকে সবসময় আমি আমার মতো করে দেখেছি। আমি যেমন সোজা ও সরলভাবে চলার চেষ্টা করি, প্যাঁচ বুঝি না, তাকেও এমনই মনে করেছি। দ্বিতীয়বার তার মুখ থেকে একই কথা শুনে আমি বিরক্ত। অন্য কারও ওপর নয়, নিজের ওপর। কেননা যা আমি করছি না, কেন তা নিয়ে কথা হবে। তিনি সেদিন তার পত্রিকা প্রকাশ, যোগদান নিয়ে কিছু বললেন না। তার ফোন রেখে মনে মনে অনেক কিছু ভাবি। এরপর দু’একদিন কাজে মনোযোগ কেন জানি কমে যায়। কিন্তু বিষয়টি অফিসের কেউ জানে, কারো কোন আচরণে কিন্তু এমন কিছু মনে হয়নি। আবারও শাহ আলম সাহেবের দেখা। তিনি আগের মতোই আচরণ করছেন। তবে আমি নিজে মানসিকভাবে কেন জানি দুর্বল হয়ে পড়ি। দু’দিন পর আবার শামীম সাহেবের ফোন। তিনি বললেন, শাহজাহান ভাই, কাল সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কফি খেয়ে যাবেন। কথা আছে। বললাম ঠিক আছে। পরদিন গেলাম। তিনি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, আপনি প্রতিদিনে থাকতে পারবেন না। শাহ আলম সাহেব আপনাকে ভালভাবে দেখছেন না। আমি জানতে চাইলাম আপনার সাথে এই যে কথা হয়, আসি তাকে বলে কে? পত্রিকা নিয়ে তো ক’দিন আগে আপনিই কথা বলেছেন। আমি বলিনি। আমি আপনার প্রস্তাবে হ্যাঁ-না কিছু বলিনি। তবে আপনি যা বলছেন তা এতটা গড়াল কীভাবে? আর আমি তো অফিসে কারও আচরণে এমন কিছু বুঝি না। শাহ আলম সাহেবের সাথে দেখা হয়। কথা হয়। তাকে তো আমি স্বাভাবিকই দেখি। জবাবে তিনি বলেন, আমার এখানে অনেক লোক আসে। বসুন্ধরার লোকও আসে। নিশ্চয়ই কেউ দেখেছে। আর আমি পত্রিকা করব অনেকে জানে। আপনার কথা অনেকেই আমাকে বলেছে। আমি তাদের বলেছি, কাগজ বের করলে শাহজাহান ভাইকে আনার চেষ্টা করব। এসব কথার পর তাকে আমি বললাম, বসুন্ধরা পত্রিকার পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করেছে এবং করছে। আপনি পারবেন? পত্রিকা কিন্তু হাতির খোরাক। অনেকেই এগিয়ে এসে পরে সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেকার করে দিয়ে গুটিয়ে নেয়। শামীম সাহেব বললেন, আমার কোন সমস্যা হবে না। আমি বললাম, পত্রিকা চালাবে সম্পাদক, তার মতো করে। আপনি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। দু’তিন বছর অব্যাহতভাবে বিনিয়োগ করবেন। এর আগে লাভ-লোকসানের প্রশ্ন তোলা যাবে না। আপনার ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী হলেই কাউকে নিয়ে আপনার ইচ্ছামতো লিখে দিতে বলবেন, তা হবে না। ঘটনা সত্য হলে অবশ্যই সংবাদ হবে, ইনিয়ে বিনিয়ে নয়। তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই। আমরা একটি ভাল কাগজ করব। পরিচ্ছন্ন কাগজ। আমি বললাম, আপনি আরও ভাবেন। ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে আমাকে জানান। ক’দিন পর এক বিকেলে তিনি আবার ফোন করলেন। বললেন, শাহজাহান ভাই, আপনি যা বলেছেন সব ঠিক আছে। আমি রাজি। আর আমার ফান্ড রেডি আছে। প্রেস আনব। আমার নিজস্ব জায়গা আছে। অফিসের জন্য ল্যাবএইডের পাশেই গ্রীন রোড়ের ৮তলা ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলা রেডি আছে। এ ভবনে ল্যাবএইডের অন্যান্য অফিসও আছে। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমি কাল আসব। কথা বলব।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here