‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ২০)

0
423

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ২০)

টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।

মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার এবং পদত্যাগ

২ নভেম্বর ’৯৪। বেলা ২টা। হঠাৎ দুপুরে বাসার টেলিফোন বেজে উঠলো। আমার স্ত্রী উঠে টেলিফোন ধরলেন। তিনি জানালেন, তথ্যমন্ত্রী কথা বলবেন। আমি টেলিফোন ধরলাম। সাথে সাথে মন্ত্রীর পিএ লাইন থ্রো করলো মন্ত্রীকে। আমি হ্যালো বলতেই তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বললেন, আপনার খবর-টবর কী, দেখি না মোটেই। আমি বললাম, রাজনৈতিক অবস্থার কারণে ব্যস্ত আছি। নিনিয়ান সাহেব তো বেশ আরামে আছেন, তার খাওয়া-দাওয়াও ভালই হচ্ছে, আমরা তো রাস্তায় দৌড়ে শেষ। তাই দেখা-সাক্ষাৎ তেমন কারো সাথেই হয় না। জবাবে তিনি বললেন, এখনই চলে আসুন সচিবালয়ে, খবর আছে। আমি বললাম কী খবর? তিনি বললেন, আগে আসুন। ভাল খবর। আমি আবার বললাম কাল সকালে এলে হয় না। আমার হাতে আজ অনেক কাজ আর এই মাত্র বাইরে থেকে এসে খেতে বসেছি। সচিবালয়ে অফিসের সময়ও শেষ প্রায়। তিনি বললেন, আমি আছি আপনি আসেন। আমি আর না করতে পারলাম না। খাওয়া শেষ করে সচিবালয়ে গিয়ে হাজির হই। নাজমুল হুদা সাহেবের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভালই ছিল। তিনি যা বলেন সোজসুজি বলেন, ঘোরপ্যাঁচ করেন না। সচিবালয়ের সর্ব-উত্তরের ভবনের ৯ তলায় তার অফিস। লিফটে উঠে পূর্বপাশ ঘুরে তার রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। এসময় পিএ এসে বললেন স্যার আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেছেন। আপনি একটু বসুন। আমি মন্ত্রীর রুমসংলগ্ন একটি সোফায় বসলাম। মন্ত্রী ভিতরে লালবাতি জ্বালিয়ে কথা বলছেন। পিয়নকে জিজ্ঞেস করলাম কে ভিতরে। সে জানালো স্যারের চাচা। আমি চানতে চাইলাম চাচার নাম। পিয়ন জানালো, সালমান এফ রহমান সাহেব। নাজমুল হুদা ও সালমান রহমানের বাড়ি ঢাকার দোহার থানায়। আত্মীয়তার সম্পর্কও আছে। তবে কী ধরনের চাচা-ভাতিজা তা জানি না। পরে এই চাচা-ভাতিজার মধ্যে বেশ বৈরিতা দেখতে পাই। দু’জন একই আসন থেকে নির্বাচনও করেন। সালমান রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নাজমুল হুদার কাছে হেরে যান। আমার সঙ্গে সোফায় তখন বসে আছেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ঠিকানা প্রত্রিকার সম্পাদক শাহীন সাহেব। তার বাড়ি বৃহত্তর সিলেটে। বিএনপি’র সমর্থক। কথায়-কথায় জানালেন তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী হতে আগ্রহী। ৫ মিনিটের মধ্যেই সালমান এফ রহমান চলে গেলেন। আমি সাথে সাথে মন্ত্রীর রুমে প্রবেশ করি।

বেলা তখন সোয় ৩টা। রুমে আমরা দু’জন। মন্ত্রী নিষেধ করে দিয়েছেন, এখন কাউকে যেন আসতে দেয়া না হয়। বললাম, কেন খবর দিয়েছেন? বড় কিছু আছে নাকি? মন্ত্রী বললেন, আছে। জানতে চাইলাম কী? মন্ত্রী বললেন, আমি একটি সাক্ষাৎকার দিতে চাই। আমার প্রশ্ন, কী বিষয়ে। কেননা ইত্তেফাকে সাক্ষাৎকার ছাপা হয় নিতান্তই কম। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকলে ছাপা হতে পারে। মন্ত্রী জানালেন, আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে চাই। এ কথা বলে একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন। কাগজে তার মত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখার বর্ণনা আছে। যাতে সরকার পদত্যাগ করলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিগণ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা সম্পর্কে মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সাক্ষাৎকার দেবেন এটা শুনে এবং ফর্মুলা দেখে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কেননা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতৃবৃন্দ এ দাবি মানতেই চান না। স্বীকারই করেন না। আর নাজমুল হুদা সাহেবও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন কট্টর সমালোচক। তাই মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলাম এ বক্তব্য আপনার ব্যক্তিগত না দলের পক্ষ থেকে দিচ্ছেন। মন্ত্রী জানালেন, তার ব্যক্তিগত। আমি বললাম, যেখানে আপনার দল রাজি নয়, সেখানে আপনি ব্যক্তিগতভাবে এরকম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতামত দিলে আপনারই বিপদ হতে পারে। আর তথ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনি সরকারের মুখপাত্রও বটে। অন্য কোন মন্ত্রী আর আপনার বক্তব্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান আছে। তিনি জানালেন, বুঝে-শুনেই দিচ্ছেন। কী এমন হয়েছে হঠাৎ এ বিষয়ে আজই বক্তব্য দিতে চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা গতকাল মানিক মিয়া এভিন্যুর জনসভায় সংসদ থেকে পদত্যাগের যে-কথা বলেছেন এতে আমি খবুই মর্মাহত হয়েছি। কাল থেকেই আমি মনে মনে স্থির করেছি এ বিষয়ে কীভাবে কী করা যায়। অনেক চিন্তা করে আমি স্থির করেছি, এভাবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্ভব। আমি আবার তাকে বললাম প্রধানমন্ত্রীর (বেগম খালেদা জিয়া) সঙ্গে কি আপনার এ ব্যাপারে কথা হয়েছে? জবাবে তিনি বললেন, না। তবে তিনি জানালেন, প্রধানমন্ত্রীকে আমি চিনি, তাকে বুঝিয়ে বললে তিনি না করবেন না। প্রায় ১৫ মিনিট এভাবে কথাবার্তা চললো এবং রূপরেখাটি পড়ার পর আমি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ছাপা হলে দেশ-বিদেশে সাড়া পড়বে। কিন্তু আমার কাছে ক্যাসেট রেকর্ডার ছিল না। এভাবে শুনে প্রতিবেদন লিখে যদি কোন শব্দের হেরফেরের কারণে বিপদে পড়ি। আমি তখন মন্ত্রীকে ঘটনা বললাম, আপনার জন্যও ভাল হবে, আমার জন্য ও ভাল হবে সাক্ষাৎকারটি লেখার পর আপনি যদি দেখে স্বাক্ষর করে দেন। আমি সাক্ষাৎকারটি সেখানেই লিখে ফেলি। পরে মন্ত্রী কম্পিউটারে কম্পোজ করার জন্য পাঠান। আমি বললাম কম্পিউটার কম্পোজে সময় লাগবে। আমি বরং ঘুরে আসি। যাওয়ার সময় মন্ত্রীর এপিএসকে বলে যাই একঘণ্টা পর গাড়ি দিয়ে যেন আমাকে প্রেস ক্লাব থেকে আনা হয়। বিকাল তখন সাড়ে ৫টা। আমি প্রেসক্লাবের কেন্টিন থেকে বের হয়ে গেইট পর্যন্ত এসেছি। ততক্ষণে এপিএস সাহেব এসে আমার অপেক্ষায় বসে আছেন। প্রেসক্লাবে ঘণ্টাখানেক থাকার সময় অনেকের সঙ্গে দেখা হলেও এ ব্যাপারে আমি মুখ খুলিনি। যাহোক ৫ মিনিটের মধ্যেই সচিবালয়ে মন্ত্রীর রুমে পৌঁছলাম। ততক্ষণে কম্পোজ করা তিন পৃষ্ঠার সাক্ষাৎকার মন্ত্রীর টেবিলে এসে গেছে। মন্ত্রী পড়ে তিন পৃষ্ঠায়ই স্বাক্ষর করলেন। আমি তাকে সালাম জানিয়ে বের হয়ে সোজা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় গেলাম। সেখানে নিনিয়ান ছিলেন। কোন খবর আছে কিনা এক চক্কর দিয়ে জেনে যাওয়া। অবশ্য আজকের দিনের সবচাইতে বড় খবর তো আমার পকেটেই আছে। প্রতিদিনের মত ১৫-২০ জন রিপোর্টার যথারীতি বসে আছেন মেঘনার সামনের ফুটপাতে। ফুটপাতে বসা আর মেঘনার গেইটে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে রওনা হলাম। সবাই বললো, আজ এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন? আমি বললাম, আজ মনে হয় না তেমন কিছু আর পাওয়া যাবে। কেউ কিছু বুঝতেও পারলো না। আমি রিকশায় উঠতেই ইনকিলাবের সাইফুল আলম বললো (বর্তমানে যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) আমিও যাবো। সাইফুল তার অফিসে নেমে যান। পাশাপাশি অফিস। আমি ঠিক সোয়া ৭টায় অফিসে পৌঁছে টাইপ করা কাগজগুলো বের করে লেখা শুরু করলাম। ৪০ মিনিটে লেখা শেষ। বার্তা সম্পাদক বাতেন ভাই দায়িত্বে। লেখা শেষ করে আমি মোবাইলে ফোন করলাম সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবকে (তিনি তখন ইত্তেফাকের সম্পাদক ও প্রকাশক)। তাকে বিশদভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং বক্তব্য সম্পর্কে জানালাম। তিনি তখন সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতার রুমে জোট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন। আমিও জানতাম বিকেলে বৈঠক ছিল। কিন্তু ৮টা পর্যন্ত চলছে তা জানতাম না। সংসদে আমারও যাওয়ার কথা ছিল। প্রতিদিনই যাই। কারণ তখন সম্মিলিত বিরোধীদলের খবর আমিই কভার করি। কিন্তু নাজমুল হুদার সাক্ষাৎকারের কারণে মেঘনা হয়েই অফিসে ফিরে আসি। সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে নাজমুল হুদার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে আমার আলাপ বৈঠকে উপস্থিত কেউ কেউ হয়তো আঁচ করে ফেলেন। কেননা বৈঠকের মাঝেই আমাদের কথোপকোথন হয়। সম্পাদক সাহেব আমাকে বললেন, ভলো ভাবেই ছাপা হবে, বাতেন সাহেবকে বলো (বাতেন সাহেব তখন যুগ্ম বার্তা সম্পাদক)।সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে কথা শেষের ১০ মিনিটের মধ্যে বাংলাবাজারের মনোয়ারুল ইসলাম (এখন আমেরিকাপ্রবাসী) সংসদ ভবন থেকে আমার কাছে টেলিফোন করে জানায়, শাহজাহান ভাই, আপনি কী নিউজ দিয়েছেন, যাতে সংসদ ভবনে হৈ-চৈ পড়ে গেছে। আমি জানতে চাই কিসের হৈ-চৈ। মনোয়ার জানায়, এখানে কেউ কেউ বলাবলি করছেন বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়েছে। আমি তাকে জানাই, এমন কোন খবর আমার কাছে নেই। আমি সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে একটি নিউজ নিয়ে আলোচনা করেছি মাত্র। তার নির্দেশ চেয়েছি এর বেশি কিছু নয়। মনোয়ারের সাথে কথা শেষ করে আমি বাতেন ভাইয়ের কাছে সাক্ষাৎকারটি দিয়ে বলি সম্পাদক সাহেবের সাথে এ-ব্যাপারে আমার আলোচনা হয়েছে। আপনিও কথা বলে নিতে পারেন। ভালভাবে যাবে বলেছেন। তিনি পড়ে হেডিং দিয়ে সংবাদটি ছেড়ে দেন। পরদিন এ সংবাদই প্রধান সংবাদ হবে। আমি নিজের ডেস্কে এসে বিরোধীদলের বৈঠকের খবরের জন্য বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি ডায়াল করার আগেই ফোন আসতে থাকে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, এমনকি ঢাকার বাইরে খুলনা ও বগুড়া থেকেও স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিকরা ফোন করলেন। তাদের সবারই একই জিজ্ঞাস্য, সরকার কি দাবি মেনে নিয়েছে? এর মধ্যে সংগ্রামের আজম মীর (এখন নয়া দিগন্তের যুগ্ম সম্পাদক), ভোরের কাগজের কাদির কল্লোল (এখন বিবিসি’র প্রতিনিধি) টেলিফোন করে বললো, আপনি কোথা দিয়ে কী করলেন আমরা কিছুই জানলাম না। বলারই কথা, কেননা তাদের সঙ্গে দু’বেলা নিয়মিত সাক্ষাৎ হয়। মাঠে একসঙ্গে কাজ করি। কিছুক্ষণের মধ্যে দৈনিক বাংলা থেকে জহির ভাই (পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ছিলেন) টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, কী বলেছেন নাজমুল হুদা। আমি বিনয়ের সঙ্গে জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করলাম। জহির ভাইও আর কিছু জানতে চাননি। কাউকে আমি সাক্ষাৎকারের বক্তব্য জানাইনি। সাবাইকে বলেছি কাল ছাপা হলে দেখবেন। রাত সাড়ে ১০ টায় সম্পাদক সাহেব টেলিফোন করে বললেন, শোন, নাজমুল হুদার সাক্ষাৎকার ছাপা হবে না। মন্ত্রী নিজেই প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। আমি হতবাক হলাম। দুঃখিত হলাম। একজন রিপোর্টার হিসাবে সে মুহূর্তে আমার যেন মৃত্যু হয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, এমন খবর একজন রিপোর্টারের জীবনে দু’একটি পাওয়াও কঠিন। আমি বিষণœবদনে বসে রইলাম। ঠিক ১১টার সময় টেলিফোন এলো মন্ত্রী নাজমুল হুদার। তিনি খুবই ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, সাক্ষাৎকারটি ছাপাবেন না, আমি দুঃখিত। মঞ্জু সাহেবকেও বলেছি। তার কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেল তিনিও মর্মাহত। আমার গলার স্বর বের হচ্ছিলো না, তবুও জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, কেন এমন হলো? তিনি বললেন, খবরটি সবাই জেনে গেছে। বুঝতেই পারছেন এখন অবস্থা। তার সঙ্গে আমার আরও কিছু কথা হলো। সব কথা বলা যাবে না। রিপোর্টার হিসেবে আমরা অনেক ঘটনার সাক্ষী, অনেক কিছু দেখি, অনেক কথা শুনি। কিন্তু সবকিছু সবসময় বলা ও লেখা যায় না।

রাত সাড়ে ১১টায় আমি অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় এলাম। ভারাক্রান্ত মন দেখে স্ত্রী বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। খেয়ে সটান শুয়ে পড়লাম। আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিক টেলিফোন করলেন। ছাপাই যখন হবে না তখন আমি অতি আপন দু’একজনকে বিষয়বস্তু সবিস্তারে বললাম। পরদিনও মন খুব খারাপ ছিল, যথারীতি প্রেসক্লাব, নিনিয়ানের অবস্থান ও সংসদ ভবনে গিয়েছি। সর্বত্রই একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। সাক্ষাৎকার ছাপা না হওয়ায় অনেক বেশি চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। অফিস, ব্যাংক ও আদালত পাড়ায়ও এ নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হয়েছে। পরদিন দুপুরে আবার আমি তথ্যমন্ত্রীর অফিসে টেলিফোন করলাম। তার সঙ্গে অল্পবিস্তর কথা হলো। আমি ততক্ষণে জেনেছি সরকারের বেশ কয়জন মন্ত্রী নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত ও শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগ এনেছেন। তথ্যমন্ত্রী জানালেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে তখনও কিছু বলেননি। সেদিন এভাবেই কেটে গেল। কিন্তু পরদিন সকালে যখন দৈনিক পত্রিকাগুলো নিয়ে পড়তে বসলাম তখন ইনকিলাবে দেখি আমাকে দেয়া আগের দিনের তথ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার হুবহু ছাপা হয়ে গেছে। এতে আমি আরও দুঃখ পেলাম, আমরা ছাপাতে পারিনি, অথচ অন্য কাগজে ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটি কৌশল করেছেÑনাজমুল হুদা সাক্ষাৎকার তাদের দিয়েছিল এমন বলেনি। যথাসম্ভব মনে পড়ে শিরোনাম ছিল, যে সাক্ষাতকার ছাপা হয়নি…। যা হোক সেদিনই নাজমুল হুদার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা ও বক্তব্য জানতে পারেন সবাই। বাতিলকৃত সাক্ষাৎকারটি ছাপা হওয়ার পর বিএনপি’র ভিতরের কট্টরপন্থীরা নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে কেউ-কেউ এমনও বলেছেন, যে রিপোর্টার সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাকেও দেখতে হবে। আমি সব খবর পেলাম নানা সূত্রে। তবে মোটেও চিন্তিত ছিলাম না। কারণ নাজমুল হুদা যে-সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তার কাগজপত্র আমার কাছেই আছে। আর ইত্তেফাক কথামতো সাক্ষাৎকার ছাপেনি। ইনকিলাব নিজস্ব সোর্স থেকে সংগ্রহ করে ছেপেছে। আমি আগেই বলেছি নাজমুল হুদা এক কথার লোক। সোজাসুজি কথা বলতেন। প্যাঁচে যেতেন না। ইনকিলাবের বক্তব্যকে তিনি তার বক্তব্য হিসেবে স্বীকার করে নেন। ফলে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে হয়। তবুও তিনি পিছপা হননি। নাজমুল হুদার পদত্যাগের পরেও এ নিয়ে কানাঘুষা চলতে থাকে। সরকারি দলের কেউ-কেউ আমার নাম উল্লেখ করে বলেন, রিপোর্টার খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে, এ বিষয়ে দেখা উচিত। বিভিন্নভাবে আলোচনাও হতে থাকে। এ খবর বিরোধীদল পর্যন্ত গড়ায়। একদিন গভীর রাতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা জানালেন, তোমাকে নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। নাজমুল হুদার বিষয়টিকে সরকার সিরিয়াসলি নিয়েছে। সম্ভবত তদন্তও হবে। হয় তোমাকে রাজসাক্ষী, না হয় রাষ্ট্রদ্রোহী হতে হবে। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে জানতাম। কিন্তু এতটা সিরিয়াস জানতাম না। যাহোক শেষ পর্যন্ত নাজমুল হুদা সকল দায়-দায়িত্ব স্বীকার করায় এ বিষয়টি আর বেশিদূর গড়ায়নি। শুধু তাকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। পদত্যাগের পর তিনি তার ধানমন্ডির বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারের কারণে তার মন্ত্রিত্ব গেছে তাই আমি দূরে দূরে ছিলাম। কিন্তু তিনিই আমাকে সামনে ডেকে নিয়ে যান। মনে হলো সবকিছুকে অত্যন্ত সহজভাবে নিয়েছেন। সেদিন তিনি তার বাসায় আমাদের মিষ্টিমুখও করিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালীদের মধ্যেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হল। সুদূর আমেরিকায় চিকিৎসাধীন গোলাম সারওয়ার (তখন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক ছিলেন, এখন সমকাল সম্পাদক) টেলিফোন করে জানতে চাইলেন, তুমি কি এমন সাক্ষাৎকার নিয়েছিলে যে আমেরিকায় বাংলা পত্রিকাগুলোতেও লেখালেখি ও নানা মহলে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি তাকে সবকিছু খুলে বললাম।

দু’দিন পরের ঘটনা। সকাল সাড়ে ১০টায় সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন সরকার দলীয় (বিএনপি) সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানকে দেখতে যাই। আমি জানতাম না তিনি অসুস্থ ছিলেন। আগের দিন ইউএনবি’র রাশেদ (বর্তমানে ইটিভি’র বার্তা প্রধান) টেলিফোন করে অসুস্থতার খবর জানিয়ে বলেন, আখতার ভাই আমাকে যেতে বলেছেন। রাশেদ, আমি এবং আরেকজন সাংবাদিক তাকে দেখতে যাই। আখতার সাহেব তখন হৃদরোগে আক্রান্ত। হাসপাতালের বেডেই তিনি দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজের মতামত লিখেছেন, তা বিবৃতি আকারে দিতে চান। আমি পড়ে দেখি তার মতামত সরকারের বিরুদ্ধে যায়। ভাবলাম আবার কোন ঝামেলায় পড়ি। যাহোক তার সঙ্গে কথা বলে বিবৃতিটি নিয়ে এলাম। অন্যদের সঙ্গে কথা ছিল সেদিন বিবৃতিটি দেবো না। সবাই একসঙ্গে পরদিন দেবো। কিন্তু আমি অফিসে পৌঁছে সম্পাদক সাহেবকে মেজর আখতারের বিবৃতির কথা জানালে তিনি দিয়ে দিতে বলেন। পরদিন ইত্তেফাকে তার বিবৃতিটি ছাপা হয়। ইউএনবি প্রচার করেনি এবং অন্য কোন কাগজেও ছাপা হয়নি। রাশেদ পরদিন আমাকে ধরলো। আমি তাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। রাশেদ শান্ত হলো। পরে অবশ্য বিএনপি সদস্য নূরুল ইসলাম মনিও সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছিলেন।
আরেকটি ছোট ঘটনা। নাজমুল হুদার সাক্ষাতকার গ্রহণের দিন বিরোধীদলের বৈঠক শেষে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমাকে ফোন করে বললেন, আমি অফিসে আসছি, তুমি সাক্ষাতকারের একটি ফটোকপি করে রাখ। আমি দেখব কি বলেছে। আমি ফটোকপি করে রাখি। অফিসের নিচে এসে তিনি আবার ফোন করে বললেন, কপিটি নিয়ে নিচে যেতে। নেমে দেখি গাড়ির ড্রাইভিং আসনে তিনি আর পাশে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তিনি তখন এনডিপি নেতা এবং এমপি ছিলেন। তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সাথে তিনিও যুক্ত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসি হওয়াদের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের একজন। মঞ্জু সাহেবের হাতে ফটোকপি তুলে দিলে তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ফিরে যান।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here