বাংলা খবর ডেস্ক:
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন জো বাইডেন। পাশাপাশি প্রথম কোনো নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস।
বুধবার ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে এ শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয় সময় বেলা ১২টায় দেশটির প্রধান বিচারপতি জন রর্বাটস বাইডেনকে শপথ পড়ান। অন্যদিকে বিচারপতি সোনিয়া সোতোমেয়র কমলা হ্যারিসকে শপথ পড়িয়েছেন।
এর আগে সকালে মেলানিয়াকে নিয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়েন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আগেই জানিয়ে দিয়েছেন বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না। তবে অনুষ্ঠানে বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন।
নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বাইডেনের স্ত্রী জিল বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্টর স্বামী ডগলাস এমহফ। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার স্ত্রী মিশেল ওবামা, বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তার স্ত্রী লরা বুশ, ডেমোক্র্যাট নেতৃবৃন্দ, পদস্থ কর্মকর্তা, হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা।
অন্যান্য সময়ে ক্যাপিটল হিলের সামনে হাজার হাজার মার্কিনি অভিষেক অনুষ্ঠান উপভোগ করে থাকেন। তবে করোনা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে এক প্রকার লকডাউনে রাখা হয়েছে ক্যাপিটল হিল।
শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে নজিরবিহীন নিরাপত্তা বলয় গড়া হয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি জুড়ে। ক্যাপিটল হিলে বাইডেনের নিরাপত্তার জন্য ২৫ হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
৩ নভেম্বর মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। আর প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হয়ে ইতিহাস গড়েছেন কমলা হ্যারিস।
নতুন আমেরিকা গড়ব : বাইডেন
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেন। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে স্থানীয় সময় বুধবার দুপুর ১১টা ৪৮মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৪৮ মিনিট) শপথ পাঠ করেন তিনি। এর প্রায় পাঁচ মিনিট আগে শপথ নেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।
শপথ নেওয়ার আগ মুহূর্তে টুইট করেন বাইডেন। এতে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন দিনের শুরু হলো। আর শপথ নেওয়ার পর ভাষণে তিনি বলেন, সবাই মিলেই নতুন আমেরিকা গড়ে তুলব।
শপথ অনুষ্ঠান ঘিরে ক্যাপিটল হিলে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের ভয়াবহ তাণ্ডবের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা ছিল, এ নিয়ে ছিল অনেক উৎকণ্ঠাও। তবে শেষ পর্যন্ত স্বস্তিতেই শেষ হয়েছে শপথ অনুষ্ঠান।
এ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উপস্থিত ছিলেন না। ১৮৬৯ সালের পর এবারই প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট উত্তরসূরির শপথ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলেন। খবর বিবিসি, সিএনএন, এএফপি ও রয়টার্সের।
৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করে বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে বাইডেনের বিজয় ট্রাম্প পুরোপুরিভাবে মেনে নিতে পারেননি। আদালত পর্যন্ত তিনি যান। এছাড়া কংগ্রেসে বাইডেনের বিজয় অনুমোদনের দিন ৬ জানুয়ারি উগ্রপন্থি সমর্থকদের তিনি উসকানি দিয়েছিলেন।
ওইদিন ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলায় এক পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়। ট্রাম্পের মেয়াদের শেষ দুই সপ্তাহের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাইডেন শপথ নিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি একনিষ্ঠভাবে শপথ গ্রহণ করছি যে, আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের দায়িত্ব সম্পাদন করব এবং আমি আমার সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও প্রতিপালন করব।’
এ শব্দগুলো উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্টে পরিণত হন। শপথ নেওয়ার পর জো বাইডেন হোয়াইট হাউজে চলে যান। হোয়াইট হাউজই তার আগামী চার বছরের কর্মস্থল ও বাসস্থান।
করোনাভাইরাসে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি, মহামারির ধাক্কায় নাজুক অর্থনীতি, ভেঙে পড়া পররাষ্ট্র নীতি, ক্ষমতা হন্তান্তর নিয়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চূড়ান্ত অসহযোগিতা আর সহিংসতার আশঙ্কার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন। কংগ্রেস ভবন পেছনে রেখে নির্মিত সুউচ্চ মঞ্চে দাঁড়িয়ে শপথ নেন বাইডেন। এর আগে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন কমলা হ্যারিস। তাদের শপথ পড়ান যথাক্রমে প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস ও বিচারপতি সোনিয়া সটোমাইয়র। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি প্রেসিডেন্টের ৫৯তম শপথ অনুষ্ঠান।
শপথ অনুষ্ঠানে বাইডেনের স্ত্রী জিল বাইডেন ও কমলা হ্যারিসের স্বামী ডাউ এমহফসহ দুই পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাজারখানেক অতিথি, যাদের অধিকাংশই কংগ্রেস সদস্য ও বাইডেন-হ্যারিস পরিবারের লোকজন।
শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিদায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। তবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ অনুষ্ঠানের তিন ঘণ্টা আগে স্ত্রী মেলানিয়াসহ ওয়াশিংটন ছেড়ে চলে যান। ১৮৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্র– জনসনের পর এবারই প্রথম বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার উত্তরসূরির অনুষ্ঠানে থাকলেন না। অবশ্য অনেক আগেই ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে থাকবেন না।
সাধারণত প্রেসিডেন্টের অভিষেক হয়ে থাকে আনন্দ-উল্লাসমুখর পরিবেশে। হাজার হাজার মানুষ অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপন করতে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো হন। কিন্তু ৬ জানুয়ারিতে কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের ভয়াবহ হামলার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেদিকেই এবার বেশি মনোযোগ দিতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে।
এবার ডিসিতে ২৫ হাজার ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়। বেশকিছু রাস্তা বন্ধ করে ও উঁচু সব বেষ্টনী দিয়ে ক্যাপিটল ভবন সুরক্ষিত করা হয়। চলাফেরাতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ওয়াশিংটনে বিপুলসংখ্যক সেনা সমাবেশ ঘটনানো হয়।
৬ জানুয়ারি মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে উগ্র ট্রাম্প সমর্থকদের তাণ্ডবের কথা মাথায় রেখে শপথ অনুষ্ঠানস্থল কড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়। তল্লাশি থেকে নিরাপত্তারক্ষীদেরও ছাড় দেওয়া হয়নি। এমনকি প্রত্যেক সদস্যের অতীত রেকর্ড পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষা চালাতে গিয়ে ১২ নিরাপত্তারক্ষীকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
সহিংস বিক্ষোভের শঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যের সবকটিতে এবং ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় বিশেষ সতর্কতাও জারি করা হয়। আট রাজ্যের পুলিশকে ওয়াশিংটন ডিসির নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়। বুধবার নজিরবিহীন নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শপথ নিয়েছেন জো বাইডেন। মার্কিন সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জানান, ১২ জন ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ডকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যেকেই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিলেন। এর মধ্যে একজনের সঙ্গে চরমপন্থি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের যোগাযোগ আছে বলে জানানো হয়েছে। আরেকজন সম্প্রতি চরমপন্থি মন্তব্য করেছেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। বাকি ১০ জনের সঙ্গেও বিভিন্নভাবে চরমপন্থিদের সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের সবাইকে ওয়াশিংটন থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য শুধু ওয়াশিংটনে ২৫ হাজার ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হয়। ওয়াশিংটনে কারফিউ জারি করা হয়। প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষকে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় কংক্রিটের গার্ড ওয়াল রাখা হয়েছে। ন্যাশনাল গার্ড সদস্যরা গোটা শহরে ফ্ল্যাগ মার্চ করছে।
বাইডেনের জন্য চিঠি রেখে গেছেন ট্রাম্প : যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার উত্তরসূরি জো বাইডেনের জন্য একটি চিঠি রেখে গেছেন। তবে চিঠিটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে এখনো কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। এছাড়া ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্পও তার উত্তরসূরি জিল বাইডেনের জন্যও একটি চিঠি রেখে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক ইতিহাসের প্রথা অনুযায়ী প্রেসিডেন্টরা অভিষেকের দিনই তার পূর্বসূরিদের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়ে আসছেন। এসব চিঠিতে সাধারণত শুভেচ্ছা বার্তা এবং পরামর্শ লেখা থাকে। সাধারণত এসব চিঠি রাখা থাকে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসের ডেস্কে। যাতে নতুন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করেই সেই চিঠিটা হাতে পান।
বারাক ওবামার কাছ থেকে একই রকম চিঠি পেয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই চিঠিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছিলেন ওবামা। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রাত্যহিক রাজনীতির টানাপোড়েনের পরও আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী রাখার দায়িত্ব আমাদের, অন্ততপক্ষে যেমনটা পেয়েছিলাম, তেমনটা রেখে যাওয়াটা জরুরি।’
বিল ক্লিনটনকেও চিঠি দিয়ে গিয়েছিলেন জর্জ এইচডব্লিউ বুশ। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘আপনার মঙ্গল কামনা করি। আপনার পরিবারের মঙ্গল কামনা করি। আপনার সফলতা এখন আমাদের দেশের সফলতা। আপনার ভিত্তি মজবুত রাখার জোরালো চেষ্টা করেছি আমি।’
হার না-মানা বাইডেন হোয়াইট হাউজে : ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্রের যেসব নীতি বদলে ফেলা হয়েছিল, সেগুলো আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বাইডেনের কাজ শুরু হবে দায়িত্বের প্রথম দিন থেকেই। ট্রাম্পের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব নীতি বদলে ফেলা হয়েছিল, সেগুলো আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বাইডেনের কাজ শুরু হবে দায়িত্বের প্রথম দিন থেকে।
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির আমলে বিশেষত শেষ সময়ের বিশৃঙ্খল দিনগুলোয় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে চরম বিভক্তি এবং অগণতান্ত্রিক আচরণও দেখা গেছে। এসব হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির কঠিন সময়ের মধ্যেও। মহামারিতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এ রোগের সংক্রমণ এবং মৃত্যু উভয় তালিকাতেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক নম্বরে। মহামারি মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের যে লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে, তার খেসারত দিতে হচ্ছে নাগরিকদের। অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে ভারসাম্যহীনতা। ট্রাম্পের অবজ্ঞার কারণে দেশটিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়েছে বলে অভিযোগ আছে আগে থেকেই।
দেশে কোভিড-১৯ টিকাদান শুরু হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের অবহেলায় এ কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতাও চোখে পড়ার মতো। ফলে টিকাদান কার্যক্রমও প্রত্যাশিত গতিতে এগোয়নি। এ কর্মসূচিতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের ধারেকাছেও নেই দেশটি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্ব নেওয়া বাইডেনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোভিড-১৯ মহামারি।
ট্রাম্প সমর্থকদের সমাবেশ প্রত্যাহার : যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা যে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জরুরি অবস্থার কথা উল্লেখ করে সমাবেশ বাতিল করেছে পাবলিক অ্যাডভোকেট নামে গ্রুপটি।
ট্রাম্পপন্থি অন্যান্য গ্রুপের নেতারা বলেন, তারা ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন না। তাদের একজন বলেন, ‘কংগ্রেস সদস্য, বাইডেনের কর্মকর্তা এবং ৬০ হাজার ন্যাশনাল গার্ড ছাড়া সেখানে আর কেউ থাকবে না। এদিকে ওয়াশিংটন ডিসিতে বুধবার উৎসব করেছে ডেমোক্র্যাটরা। তবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অনেক সমর্থকই শহরটিকে এড়িয়ে চলেছেন।
‘আমি মারা গেলেও ডেলাওয়ার আমার হৃদয়েই থাকবে’
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের গর্বিত সন্তান হিসাবে সব সময় আমার পরিচয় থাকবে। ডেলাওয়ারবাসীর সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা স্মরণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি যখন মারা যাব, এ ডেলাওয়ার রাজ্য আমার হৃদয়েই লেখা থাকবে।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিতে ওয়াশিংটনে যাত্রার আগে মঙ্গলবার ডেলাওয়ারের নিউ ক্যাসেল শহরে ৭৮ বছর বয়সী বাইডেন এ আবেগঘন বক্তব্য দেন। খবর বিবিসি, রয়টার্স ও সিএনএনের।
ডেলাওয়ারের ন্যাশনাল হেডকোয়ার্টারে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বাইডেন নিজের আবেগের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অকালপ্রয়াত ছেলে বিউ বাইডেনকে স্মরণ করে তিনি বলেন, আজকের দিনে আমার একটিই দুঃখ, বিউ বেঁচে থাকলে হয়তো তাকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখা যেত। মার্কিন সেনাসদস্য হিসাবে বিউ ব্রোঞ্জপদক পেয়েছিলেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির উদীয়মান রাজনৈতিক তারকা হিসাবে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি অঙ্গরাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। ২০১৫ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে অল্প দিনের মধ্যে বিউ মারা যান। এ কারণে সুযোগ থাকার পরও ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন নির্বাচন করতে অস্বীকার করেছিলেন।
বক্তব্যে অতীতের কথা স্মরণ করে জো বাইডেন বলেন, তার মা-বাবা চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে এ রাজ্যে বসতি শুরু করেছিলেন। সিনেটে ডেলাওয়ারের হয়ে ৩০ বছর দায়িত্ব পালনের আগে নিউ ক্যাসল এলাকা থেকে কাউন্সিলর হওয়ার তথ্যও তিনি তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে আট বছর দায়িত্ব পালনের কথাও তিনি স্মরণ করেন।
বাইডেন আরও বলেন, তার জীবনের সব সময়, ভালো ও খারাপ সময়ে ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের লোকজন পাশে ছিলেন। এ অঙ্গরাজ্যের মানুষ বাইডেন পরিবারের পাশে থেকেছেন। এটি তার জীবনের চরম পাওয়া বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ অঙ্গরাজ্য আমাদের অনেক দিয়েছে। আমার মা-বাবার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় এ অঙ্গরাজ্য তাদের থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। এ অঙ্গরাজ্য আমাকে নিজের প্রতি আস্থা রাখার সুযোগ দিয়েছে। রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমাকে সিনেটে পাঠিয়েছে। এ রাজ্য আমাকে জিল বাইডেনকে (বর্তমান স্ত্রী) খুঁজে পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এ রাজ্য আমার ছেলে বিউকে ভালোবাসা দেখিয়েছে। বাইডেনের বক্তব্যের সময় সেখানে উপস্থিত অনেককে অশ্রুসিক্ত হতে দেখা যায়।
অভিষেকের আগে ৪ লাখ আমেরিকানকে স্মরণ বাইডেনের : যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া চার লাখ মার্কিন নাগরিকের জন্য মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। করোনাভাইরাসে দেশটিতে প্রথম মৃত্যুর ১১ মাসের মাথায় দিনটিতে মৃতের সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে যায়। রাজধানীর পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যায় ডেলাওয়ারে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস অংশ নেন।
স্মরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে বাইডেন বলেন, এ ক্ষত শুকাতে হলে আমাদের স্মরণ করতে হবে। বেদনার এ স্মরণ কখনো কখনো খুব কঠিন। কিন্তু এভাবে আমরা সেরে উঠি। একটি জাতি হিসাবে তাদের স্মরণ করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় লিংকন মেমোরিয়ালের লেকের ধারে চার লাখ নাগরিকের স্মরণে ৪০০ বাতি জ্বলছিল। এরপর গসপেল গায়ক ইয়োলান্ডা অ্যাডামস গেয়ে শোনান ‘হালেলুইয়া’। এরপর কিছু সময় নীরবতা পালন করা হয়।
কমলা হ্যারিস বলেন, মৃত্যু তাদের শারীরিকভাবে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে হয়তো, কিন্তু চেতনায় আমরা সবাই এক জায়গাতেই আছি। আমার প্রার্থনা এটুকুই- এ সংকট আমরা কাটিয়ে উঠব নতুন শিক্ষা নিয়ে। সেই শিক্ষা হবে ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকেও মূল্য দেওয়া, নতুন সম্ভাবনার কথা ভাবতে শেখা, আর আমাদের হৃদয় পরস্পরের জন্য আরেকটু উন্মুক্ত করা।
ট্রাম্প যুগের অবসান:
ট্রাম্প যুগের অবসান হয়েছে ওয়াশিংটনে। কিছুক্ষণ আগে ওয়াশিংটন থেকে তিনি ফ্লোরিডার পথে যাত্রা শুরু করেছেন। সেখানে মার-এ-লাগো’তে অবস্থান করবেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প । আর এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সমাপ্ত হতে যাচ্ছে জমাট বাঁধা এক অবস্থায়। এ সময়ে ওয়াশিংটনের বাইরে ক্যামেরাগুলো যেন ছিল ক্ষুধিত। সত্য ছিল অভুক্ত। অন্ধকারময় একটি সময়কে অতিক্রম করে ওয়াশিংটনে আর কিছুক্ষণের মধ্যে চালু হতে চলেছে নতুন এক অধ্যায়। সে অধ্যায়ের শুরু হবে স্থানীয় সময় দুপুর বারোটায়।
এ সময় ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ডেমোক্রেট জো বাইডেন। হয়তো সেই শপথ অনুষ্ঠান সহ্য করতে পারতেন না বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প । সেই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে তিনি কয়েক ঘণ্টা আগেই ওয়াশিংটন ছেড়েছেন। যেখানে কেটেছে তার চারটি বছর, তাদের দাপটে গাছের পাতা থাকতো নীরব, সেখানকার পরিবেশ এদিন তার কাছে অচেনা। চারদিকে সামরিক উপস্থিতি। ন্যাশনাল গার্ডরা ঘিরে রেখেছে ওয়াশিংটন ডিসি। বিভিন্ন পয়েন্টে অবরুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে রাস্তাঘাট। পুরো লকডাউন। এ মাসের শুরুর দিকে সংঘটিত দাঙ্গার মতো ঘটনা যেন আর ঘটতে না পারে, সে জন্য গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তা বুহ্য। সিএনএন মন্তব্য করেছে- করোনাভাইরাস মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ৪ লাখ মার্কিনি মারা গেছে গেছেন। কিন্তু সেই ভয়াবহতাকে খর্ব করে, অবজ্ঞা করেছেন ট্রাম্প। তাই সিএনএন-এর ভাষায় তিনি এসব মার্কিনির মৃতদেহ রেখে গেলেন ওয়াশিংটনে । তার বিরোধীরা বলছেন, নতুন এক যুগের সূচনা হতে চলেছে। চার বছর যে অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে মধ্য দিয়ে, অসত্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র- তার অবসান হয়েছে।