এলিয়েনের ডেরায় ভূত

0
182

দর্পণ কবীর

জটেশ্বরের আসরটা আর আগের মতো জমে না। তন্ত্র-বিদ্যার প্রতি মানুষের আস্থা দিনদিন কমে আসছে। লোকজন আসরে তেমন তো আসছেই না, বরং আজকাল কেউ কেউ তো তাকে দেখে বিদ্রুপ করতেও ছাড়ছে না। কখনো কখনো কারো কারো বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হচ্ছে তাকে। এটা ঘোর কলিযুগের লক্ষণ। মানুষের মধ্যে ভয়-ডর কমে গেছে। কমবে না কেন? গত কয়েক বছরে তার গ্রামের চেহারাটাই রাতারাতি বদলে গেল। তাদের গ্রাম কালীনগরটা কয়েক বছর আগেও ছিল একটা গন্ডগ্রাম। এই গন্ডগ্রামেও বিজলি-বাতি এসে পড়েছে। এখন সন্ধ্যা নামলেই কালীনগরের ঘরে ঘরে বিজলি-বাতি জ্বলে উঠে। এমন কথা একযুগ আগে কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কালীনগরের আশেপাশের গ্রামগুলোও বিজলি-বাতিতে সয়লাব হয়ে গেছে। আগে মানুষ সন্ধ্যে হলেই ঘুমিয়ে পড়ত। এখন অনেক রাত অব্দি টিভি দেখে অনেকে। বাজারে সমীর মিয়ার চায়ের স্টলেও টিভি দেখা যায়। এই টিভিটাও মানুষের ভয়-ডর তাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে। তাই টিভির প্রতিও জটেশ্বরের চাপা ক্ষোভ আছে। তান্ত্রিকদের আর আহামরি দিনকাল নেই। বাপ-দাদার পৈত্রিক বিদ্যাটাই শিখেছিলেন। এই বিদ্যা নিয়ে এখন তিনি বিপাকেই আছেন। আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় সংসারে অভাবটা চিরস্থায়ী হবার পথে। এটাই হচ্ছে কলিযুগের আগ্রাসন! খুব হিমসিম খাচ্ছেন জটেশ্বর। এরমধ্যে নতুন এক উপদ্রবে পড়েছেন তিনি। গত কয়েকদিন হল রাতে একটু বেরুলেই দূর থেকে কে যেন তাকে অনুসরণ করছে- টের পাচ্ছেন। শুধু অনুসরণই নয়, তার পাশ থেকে দু’-একটি কথাও বলছে। কথা বলছে এমনভাবে যেন বক্তা তার অনেকদিনের চেনা কোনো হিতৈষী। আড়াল থেকে কেউ কথা বলে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে যেন। জটেশ্বর বুঝতে পারছেন না। তার বয়স হয়েছে বটে। আজকাল অনেক কিছু ঠাহর করতে পারেন না। এটা বয়সের কারণ। জটেশ্বরের বয়স সাড়ে তিন কুড়ি, না চার কুড়ি এ নিয়ে তার মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। তার সঠিক বয়স কত তিনি তা বলতে পারেন না। তবে বয়সটা তিন কুড়ি যে পেরিয়েছে, এ কথা হলফ করে বলতে পারেন। তার বয়স নিয়ে কথাটা আজকাল প্রতিবেশীদের মধ্যে উঠছে। এক সময় তার শরীরটা ছিল পেটানো ও তাগড়া। এই শরীরটা দিনদিন কেমন নেতিয়ে আসছে। গায়ের চামড়ায় কেমন ঢলঢলে ভাব বাড়ছে। আগে যেভাবে লম্বা-লম্বা পা ফেলে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যেতেন, এখন তেমন তোড়জোর দেখাতে পারেন না। এমনকি, খাবারের বেলায়ও এক ধরনের শৈথিল্য চলে এসেছে। ক’ বছর আগেও একটা পাঁঠার মাংশ একাই সাবাড় করে ফেলতেন। হজমও করে ফেলতেন। এখন ভূরিভোজে শরীরের সহযোগিতা পান না। ‘প্রাকৃতিক কর্ম’ সম্পদানে আগে তার কখনো বেগ পেত হতো না। এখন মাঝেমাঝে বেগ পেতে হয়। এইতো কিছুক্ষণ আগে ভোলানাথের কলাবাগানে ‘প্রাকৃতিক কাজ’ সারতে গিয়ে কী বিপত্তিতেই না পড়লেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত জমে আসতেই অমলেশ শিলের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন তিনি। পথে মলত্যাগের প্রবল চাপ উঠল। প্রবল চাপ সামলাতে না পেরে পথ থেকে তিনি ঢুকে পড়লেন ভোলানাথের কলাবাগানে। তড়িঘড়ি করে ‘প্রাকৃতিক কাজ’ সম্পাদন করতে বসেছিলেন। কিন্তু মল বের হতে গিয়ে কৌষ্ঠ-কাঠিন্যের এক অপ্রত্যাশিত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হল তাকে। পিত্তথলি থেকে মল নেমে পায়ু পথের বহিঃগমনের শেষ প্রান্তে এসে অনড় পাথর হয়ে আটকে গেল। তিনি পেটের ভেতরের বায়ুশক্তি এক করে কয়েকবার নি¤œমুখী চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন। পাকস্থলিতে বায়ুশক্তি প্রয়োগের সময় তার মুখ দিয়ে কয়েকবার ‘উ…!’ গোঙানীর শব্দ বেরিয়ে এল। গোঙানীর শব্দটা বেশি উচ্চকিত হয়ে রাতের নির্জনতাকে ভেঙে দিয়েছিল। গোঙানীর শব্দটা গিয়ে পৌঁছে গেল ভোলানাথের ঘর অব্দি। ‘কলাবাগানে কে রে!’ বলে সড়কি হাতে ভোলানাথ বেরিয়ে এল। এক ধরনের অপ্রত্যাশিত লজ্জাষ্কর ঘটনার মুখোমুখি হতেই যাচ্ছিলেন তিনি। ভোলানাথ কলাবাগানে প্রবেশের আগেই সে অনেকটা অর্ধ-দিগম্বর অবস্থায় লম্বা লম্বা পা ফেলে পালিয়ে এলেন। কলাবাগান থেকে পালানোর সময় ভাবছিলেন কৌষ্ঠকাঠিন্য রোগ-বালাই কোনো তান্ত্রিককে মানায় না। কিন্তু তার মতো বয়স্ক কারো এই রোগ হলে তাকে ঠেকাবে কী করে?
কয়েক বছর হল জটেশ্বরের ডান পায়ের গোড়ালিতে বাতের ব্যথা বাসা বেঁধেছে। গত পৌষ মাসে বাতের ব্যথা এমন বাড়ল যে, তিনি বুঝতে পারলেন বয়স তাকে জানান দিচ্ছে তিনি যথেষ্ট বুড়ো হয়েছেন। এ ছাড়া আছে হাঁপানীর কষ্ট। সব-সময় না হলেও হাঁপানীর কারণে কদাচিৎ শ্বাসকষ্ট হয় তার। হাঁপানীর কথাটা চেপে রেখেছেন এখনো। বাতের ব্যথায় পা হেঁচকে হাঁটলে তো আর তা গোপন রাখার উপায় নেই। শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট না হয় লোক-চক্ষুর আড়ালে রাখা যায়, খুঁড়িয়ে পা টেনে হাঁটতে হলে তা গোপন করবেন কীভাবে? আবার তান্ত্রিকদের খুঁড়িয়ে হাঁটাটাও সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। এতে তার তন্ত্র-বিদ্যা সম্পর্কে জনমনে ঘোরতর সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে। যে তান্ত্রিক ঝাড়ফুঁক করে, তাবিজ-তুম্বা ও নানা বুজরুকী করে রোগী বা সমস্যাগ্রস্তদের সেবা দিয়ে আসছেন, দেব-দেবীদের নামে ফলফলাদি নিয়ে অতৃপ্ত মনের বাসনা পূরণ করছেন বা আধ্যাত্মিক মন্ত্রবলে সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছেন- তিনি নিজেই যদি রোগ-ব্যাধীতে কাবু হয়ে যান, তার প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে কেন? তান্ত্রিকদের অসুখ-বিসুখ হতে নেই। কদাচিৎ অসুখ এসে শরীরে প্রবেশ করলেও তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হয় না। এটা তিনি ভাল করেই জানেন। জটেশ্বরের বছরে একবার জ্বর আসে। বর্ষাকালের কোনো একদিন তিনি জ্বরে পড়বেন। জ্বরের সঙ্গে তার লড়াই হয় দু’ বা তিনদিন। এ সময় তিনি ঘরের দরোজা বন্ধ করে পড়ে থাকেন। স্ত্রীকে কঠিন নির্দেশ দেওয়া আছে কেউ ডাকলে ভুলেও সে যেন দরোজা না খোলে। জ্বর আক্রান্ত হলে তার তন্ত্রমন্ত্রের কাজও বন্ধ থাকে। চ্যালা-চামুন্ডারাও তার ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। স্ত্রী বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে বলে দেয়Ñ দৈব শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করার লক্ষ্যে তান্ত্রিক ধ্যানে আছেন। কয়েকদিন তার ধ্যান ভাঙা যাবে না। স্ত্রী বিশাখা এ কাজটি ভালভাবেই করে আসছে।
ভোলানাথের কলাবাগান থেকে তাড়া খেয়ে বের হয়ে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটছিলেন তিনি। আকস্মিক পাশ থেকে অদেখা হিতৈষী বলল, ‘মশাই, পায়জামা হাতে নিয়ে হাঁটছেন! নিচের অংশে যে কাপড় নেই! পায়জামাটা পড়ে নিন। আর কিছুদূর এগুলেই দলিল লেখক জমসেদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। জমসেদ আপনাকে নগ্ন পদে হাঁটতে দেখলে কী অবস্থা হবে, ভেবে দেখুন তো!’
কথাটায় তার সম্বিত ফিরে এল। কথাটা শোনার পরই তিনি লক্ষ্য করলেন সত্যিই তিনি পায়জামা পড়তে ভুলে গিয়েছিলেন। দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড়ে তিনি চট করে পায়জামা পড়ে নিলেন। পায়জামাটার নুড়ি বাঁধার কয়েক সেকেন্ড পর সত্যি-সত্যিই জমসেদকে দেখতে পেলেন তিনি। জমসেদ পথের বিপরীত দিক থেকে আসছিল। পথিমধ্যে জমসেদ তাকে দেখে বক্রচোখে তাকাল একবার। দলিল লেখালেখির কাজ করে জমসেদ দ্রুত করে সচ্ছল হয়ে গেছে। ওর হাতে এখন ঢলঢল করছে কাঁচা পয়সা। একটা সময় হতদরিদ্র ছিল ও। কিছু গরীব লোক আছে, ওরা আকস্মিক ধনী হয়ে গেলে কাউকে মান্যগণ্য করতে চায় না। জামসেদও ঐ রকম লোক। তাকে একেবারেই পছন্দ করে না জমসেদ। প্রায় এক যুগ আগে জামসেদের ছয় বছরের কন্যা জোছনা গোখরা সাপের কামরে মারা গিয়েছিল। কন্যাটিকে জামসেদ খুব আদর করত। সাপে কাটার পর জোছনাকে বাঁচাতে জটেশ্বরকে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। জটেশ্বর সাপে কাটা জোছনাকে বাঁচাতে পারেননি। সেই থেকে জটেশ্বরের প্রতি জমসেদের রাগ পঞ্জিভূত। জমসেদ সে-দিন ভালভাবে বুঝেছিল- জটেশ্বরের সে ক্ষমতা নেই যে, তিনি চাইলেই কাউকে বিপদমুক্ত বা রোগমুক্ত করতে পারবেন! ফলে জটেশ্বরের তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক নিয়ে গ্রামের যারা সন্দেহ প্রকাশ করে নানা কথা বলে, জমসেদ তাদের মধ্যে একজন। জামসেদ যখন তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল, তখনই তার মনে হল অদৃশ্য কণ্ঠধারীর কথা। যিনি আড়াল থেকে তাকে পায়জামাটা পড়ে নেবার কথা বলেছিল। কয়েকদিন যাবতই তিনি লক্ষ্য করছিলেন কেউ একজন তার আশে-পাশে থাকে, অথচ দেখা যাচ্ছে না। প্রথমে এ বিষয়টি আমলে নেননি, কিন্তু এখন তার কৌতূহল হল। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালেন। কোথাও কেউ নেই। ফের তাকালেন অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। কেউ নেই। রাতের আঁধারে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এক অন্য আবহ তৈরি করে রেখেছে। তিনি এবার খুব অবাক হলেন। অদৃশ্য কেউ তাকে অনুসরণ করছে। অশরীরী! কথাটা ভাবতেই ঠান্ডা একটা স্রোত নেমে এল যেন অনুভবে। তবে ভয় পেলেন না। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। জ্বীন-ভূত নিয়ে সারাজীবন তিনি নানা কসরৎ করে গেছেন। ভয়কাতুরে লোকদের সঙ্গে ছলচাতুরী করে গেছেন। নিজে কখনো ভূত বা জ্বীনের সাক্ষাৎ পাননি। এ কথা অবশ্য কাউকে ক্ষুণাক্ষরেও বলেননি। তা এত বছর পর কি ভূত-প্রেতের সঙ্গেই সাক্ষাৎ হয়ে গেল? কথাটা ভাবছিলেন নিজের মনের সঙ্গে রসিকতা করার মানসে। কিন্তু কথাটার প্রতিধ্বনি হল যেন। আড়াল থেকে কণ্ঠটা এবার বলল, ‘মশাই, যা ভাবছেন, তা কিন্তু রসিকতা নয়। ভূত নিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বেশ তো হাতিয়ে নিচ্ছেন। অথচ ভূত আছে কি নেই, নিজেই তা জানেন না!’
কথাটায় একটু ভড়কে গেলেন জটেশ্বের। তিনি চারপাশে তাকালেন। কেউ নেই। অদৃশ্য কণ্ঠ বলল, ‘আমাকে দেখতে পাবেন না, মশাই। আমি ভূত।’
‘ভূত!’
‘হ্যাঁ, ভূত। তবে আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আপনার ঘাড় মটকে দেব না।’
জটেশ্বর ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। অদৃশ্য কণ্ঠ বলছে সে ভূত, অথচ কথা বলছে বন্ধুর মতো আন্তরিক গলায়। তিনি অদৃশ্য কণ্ঠধারী যে ভূত, এই দাবী বিশ্বাস করবেন কিনা- এটা মনে মনে ভাবতে লাগলেন। জীবন সায়হ্নে এসে এমন গোলক ধাঁধায় পড়বেন- এটা ভাবেননি। তিনি হতাশ গলায় অদৃশ্য কণ্ঠের উদ্দেশে বললেন, ‘তা ভূত সাহেব কি কেবল অদৃশ্যই থাকবেন, নাকি দৃশ্যমান হবেন? চোখে সহ্য হয় এমন একটা রূপ ধরুন না!’
‘না। আমি অদৃশ্য ভূত। মরে সবে মাত্র ভূত হয়েছি, মশাই। কোনো রূপ ধারণ করার ক্ষমতা এখনো পাইনি।’
‘ও আচ্ছা! তা ভূত মহাশয় কি আমার ওপর ক্ষেপে আছেন? স্বীকার করছি, ভূতে ধরা অনেকের নাকের সামনে লঙ্কা পুড়িয়ে আপনাদের নাকাল করেছি। কিন্তু আমি নিজেও জানতাম না, কাউকে সত্যি-সত্যি ভূতে ধরে কিনা।’
‘না জেনেই ভূত তাড়িয়েছেন! বলেন কী!’
‘আজ্ঞে, জ্বি। মানুষ আমার কাছে আসত, ভরসা করত। আমি প্রচলিত কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাস রক্ষার চেষ্টা করে এসেছি। কী বলব- বলুন, বাপ-দাদার কাছ থেকে এই বুজরুকী-ই শিখেছি। যদি জানতাম, সত্যি সত্যি কাউকে ভূতে ধরেছে, তাহলে কি ভূত তাড়ানোর দুঃসাহস দেখাতাম!’
এ কথা বলে জটেশ্বর ভীষণ অনুশোচনায় পুড়তে লাগলেন। এতকাল ভূত নেই জেনেই ভূতের বিরুদ্ধে লঙ্কা পুড়িয়ে গেছেন। কতটা গর্হিত কাজ! এখন ভূতের সামনে পড়ে তার কেমন ত্রাহি আবস্থা। ভূতের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘মশাই, এ কথায় তো আপনাকে ছাড়ছি না। আমি তো আপনার কাছে এসেছি বড় আশা করে। কয়েকদিন ধরেই আপনার পেছনে পেছনে ঘুরছি। আজ আপনার দৃষ্টিগোচর হতে পেরেছি।’
ভূতের কথায় ভাবনায় পড়ে গেলেন জটেশ্বর। এমন ঘোর বিপদে কখনো পড়েননি। তিনি অসহায়ভাবে অদৃশ্য ভূতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভূতটা এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমার পরিচয়টা জানিয়ে দিচ্ছি। আমি আপনার গাঁয়েরই লোক। আপনি মল্লিকবাড়ীর ভূবন মল্লিককে তো চিনতেন?’
‘চিনব না কেন? গত মাসে বটতলায় বজ্রঘাতে তিনি মারা গেলেন! লোকটি ভালই ছিলেন। বড্ড সরল ও বোকা ছিলেন। আহা, বেচারা, হঠাৎ করে অকালে মারা গেলেন!’
‘আমিই সেই ভূবন মল্লিক।’
‘কী বললেন, আপনি ভূবন মল্লিক?’
‘হ্যাঁ। এখন মরে ভূত হয়েছি। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু বজ্রঘাতে মরিনি। অবশ্য সকলে তা-ই জানে। কিন্তু আমার বজ্রঘাতে মৃত্যুর এই কারণটা সঠিক নয়।’
‘বলেন কি! কীভাবে মরলেন তাহলে?’
‘এ কথা বলতেই তো এসেছি। আমি আসলে খুন হয়েছিলাম সে-দিন রাতে।’
‘খুন! কে খুন করেছিল!’
‘এলিয়েন!’
বলল ভূত। নাম শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল জটেশ্বর,
‘এলিয়েন! এটা আবার কী!’
‘আরে মশাই, এলিয়েন কি জানেন না! আপনি দেখছি অনেক পিছিয়ে আছেন!’
‘তা পিছিয়ে থাকব না? বয়স তো কম হল না। আপনাকে বলতে অসুবিধে নেই আমার বয়সটা তিনকুড়ি পেরিয়েছে সেই কবেই। ডান পা-টা টানতে অনেক কষ্ট হয় আজকাল। বাতের ব্যথা ছাড়ছেই না। বরং বাড়ছে। হাঁপানীটাও বাড়ছে। এখন দেখছি, পেটের হজমশক্তিটাও লোপাট হয়ে যাচ্ছে! তন্ত্র-মন্ত্রের কসরৎ তো সেই কবেই গেছে! তা এলিয়েন না, কী যেন বলছিলেন!’
‘এলিয়েন হচ্ছে এক ধরনের প্রাণী। পৃথিবীর মতো অন্য গ্রহে ওদের বসবাস।’
‘এলিয়েন, অন্য গ্রহ, এসব কী বলছেন! এসব ভৌতিক কথা বলে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’
‘না। না। ভয় দেখাতে চাইলে কি আপনার সঙ্গে এভাবে আলাপ করতাম? মশাই, আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন তো! একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে আপনার পিছনে ঘুরছি।’
‘আচ্ছা, বলুন। শুনছি।’
‘আমাদের গাঁয়ের লোকদের ঘোর বিপদ অপেক্ষা করছে। গাঁয়ের দক্ষিণ কোণে যে প্রাচীন বটবৃক্ষটা আছে না?’
‘হুম। ওই বটগাছের কাছাকাছি একটা জায়গায় বজ্রঘাতে আপনার মৃত্যু ঘটেছিল।’
‘আবারো বজ্রঘাত বলছেন! যাই হোক, ওই বটবৃক্ষে এলিয়েনদের ডেরা। শত শত এলিয়েন এসে ওই বটবৃক্ষে আস্তানা গেড়েছে।’
‘বলেন কী!’
‘ওরা গবেষণার নামে নানা ফন্দী করছে, মশাই!’
‘গবেষণা! কী নিয়ে গবেষণা করছে ওরা?’
‘সেটাই তো আপনি জানবেন। ওদের সঙ্গে কথা বলে গাঁয়ের যাতে অনিষ্ট না হয়, সেই পদক্ষেপ নেবেন।’
‘মানে?’
‘মানে হচ্ছে, আপনি ওদের সঙ্গে কথা বলে ওদের মতলব জানবেন। বটবৃক্ষ থেকে ওদের তাড়িয়ে দিতে একটা উপায় বের করবেন।’
‘আপনি দেখছি, ভূত হয়েও আমার ক্ষমতা সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছেন। তা ছাড়া আপনি কী করে বুঝলেন যে, ওরা গাঁয়ের লোকের ক্ষতি করবে?’
‘আরে মশাই, আমাকে ওরা কৃত্রিম বজ্রঘাতে হত্যা করে গবেষণার কাজ শুরু করেছে। এমন হত্যা ওরা আরও করবে।’
‘কী করে বুঝলেন তা?’
‘আমি মারা যাবার আগে বটবৃক্ষে উঠেছিলাম।’
‘কেন? বটগাছটিতে কেউ কখনো উঠেছে বলে শুনিনি! বটগাছে ভূতের আড্ডা আছে বলে গাঁয়ের লোক গাছটিকে এড়িয়ে চলে। ঐ গাছের ধারে-কাছেও কেউ যেতে চায় না। তা আপনি কেন গাছে চড়তে গেলেন?’
‘ঐ যে আমি বোকা ও সরল মানুষ বলে। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে ভেবেছিলাম বটবৃক্ষের মগডালে চড়ে রাত কাটিয়ে দেব। গাছে উঠতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। বটবৃক্ষের মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠেছি, তখুনি আগুনের গোলার মতো দু’টি চোখ আমার সামনে এসে হাজির। প্রথমে ভেবেছিলাম বড় রকমের জোনাক পোকা। কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে ঝাঁপটা দিয়েছিলেন আগুনের চোখ দু’টিকে। কিছুই হল না। চোখ দু’টি নিমেষেই হাওয়া হল, ফের জ্বলে উঠল। বটবৃক্ষে আরেকটু উঠতে গিয়েই দেখলাম, শত শত আগুন চোখ আমাকে ঘিরে ধরল।’
‘বলেন কী! কথা শুনে গা শিরশির করছে আমার!’
‘ওদের মধ্য থেকে কে যেন আমার সঙ্গে কথা বলল। জানতে চাইল এ গাঁয়ে কত লোক আছে? কণ্ঠস্বরটা শুনলাম বটে, কোত্থেকে এল বুঝতে পারছিলাম না। আমাকে ঘিরে শত শত আগুন চোখ চক্কর দিচ্ছিল আর কী যেন ওরা সুর কেটে বলে যাচ্ছিল। আমি জানতে চাইলাম গাঁয়ের লোক কত তা জেনে কী হবে? কণ্ঠস্বরটা বলল গাঁয়ের লোকদের ওরা ওদের দেশে নিয়ে যেতে চায়। আমি বললাম- কেন। কণ্ঠস্বর বলল- গবেষণার জন্য। এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিল কণ্ঠস্বরটা। আমি রাজী হলাম না। বলুন, গাঁয়ের লোক ধরে নিয়ে যাবে আর আমি এ কাজে ওদের সহযোগিতা করতে পারি?’
‘তা ঠিক। কিন্তু ওরা কারা? ওদের পরিচয় কী? জ্বীন নয়তো?’
‘আরে, না মশাই। কণ্ঠস্বরটা বলেছিল ওরা হচ্ছে এলিয়েন। অন্য গ্রহের প্রাণী।’
‘এরপর কী হল?’
‘আমি ওদের কথা বিশ্বাস করিনি। আমি মনে করেছিলাম, গাঁয়ের দুষ্ট কোনো লোক আমাকে ভয় দেখাচ্ছে।’
‘কীভাবে? আপনি না বললেন- আগুনের চোখ!’
‘আমি তখন কী এত কিছু ঠাওর করতে পেরেছিলাম নাকি? ভেবেছিলাম কেউ হয়তো লাইটের আলো ফেলে এবং তা ঘুরিয়েও আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল। আড়াল থেকে হয়তো কেউ এলিয়েন সেজে কথা বলছে।’
‘এরপর?’
‘আমি ওসব ভেবে হঠাৎ করে এক থাবা মেরে এক জোড়া আগুন চোখ ধরে ফেললাম। একটা বিকট শব্দ হল। এরপর শুধু দেখলাম, আলোর ঝলকানি। কী হল, আর বুঝতে পারলাম না। প্রচন্ড আলো ও শব্দের মধ্যে আমি তলিয়ে গেলাম। আমার শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ খেলে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি মারা গেলাম। অর্থাৎ ওরা আমাকে মেরে ফেলল।’
‘ভগবান, এ কী শুনছি!’
অস্ফুষ্টভাবে বললেন জটেশ্বর। ভূতটা তাকে অভয় দেওয়ার মতো করে বলল, ‘আরে মশাই, ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি তো এতকাল ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া, জমি নিয়ে বিরোধ, অমুক ঘরে অশান্তি, বিদেশ যাত্রায় তাবিজ, বাড়ি বন্ধ দেওয়া, নষ্ট ছেলেকে ভাল করা, ভূতের উৎপাত বন্ধ করা, আরও কত কি করেছেন। ঝাড়ফুঁক দিয়ে তো পাগলকে সুস্থ করে ফেলেছেন বলেও শুনেছিলাম।’
‘আরও ওসব কি সব সত্যি নাকি? ওর মধ্যে অনেক ফাঁকি ছিল। ভূত বলেই বলছি, আমার তেমন কোনো কেরামতি নেই। মানুষদের বোকা বানিয়ে এ পর্যন্ত এসেছি, মা কালীর কসম খেয়ে বলছি!’
‘তাহলে একটা কেরামতি তো নিশ্চয় আছে আপনার!’
‘সেটা কী?’
‘এই যে মানুষকে বোকা বানাতে পারেন।’
‘তো?’
‘এবার এলিয়েনকে বোকা বানাবেন।’
‘কী যে বলছেন ভূত বাবাজী! আমি মুখ্য-সুখ্য মানুষ, এই এলিয়েন কী জিনিস সেটাই তো জানি না। ওদের আবার বোকা বানাব কীভাবে?’
‘দেখুন তান্ত্রিক মশাই, গাঁয়ের লোকদের রক্ষা করতে হলে আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। আপনি কি চান গাঁয়ের তাবৎ লোক এলিয়েনরা তুলে নিয়ে যাক?’
‘না, না তাই চাইব কেন?’
‘তাহলে আমার সঙ্গে কাল রাতে চলুন।’
‘কোথায়?’
‘ঐ বটবৃক্ষের নিচে।’
‘ওরে মারে! বটবৃক্ষে! ওখানে রাতে কেউ কি যায়?’
‘যাবে কী করে। ওখানে গেলেই তো এলিয়েনদের খপ্পড়ে পড়তে হয়!’
‘তাহলে আমাকে নিয়ে যাবেন কেন, ভূত বাবাজী?’
‘গাঁয়ের লোকদের রক্ষা করতে হলে আপনাকেই প্রয়োজন। আমি মরে ভূত হয়ে গেছি। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারব না। তাই আপনার সাহায্য নিতে হচ্ছে। আপনাকে যেতেই হবে।’
‘ওখানে গিয়ে কী করব? এলিয়েনকে কী বলব? ওরা কি আমার ভাষা বুঝবে?
‘কাল রাতে যেতে যেতে আমি বলে দেব আপনাকে কী করতে হবে, কী বলতে হবে। আপনি শুধু আমার কথা শুনবেন। মোদ্দা কথা, এলিয়েনদের বুঝাতে হবে এই গাঁয়ের লোকেরা শান্তিপ্রিয়। ওদের নিয়ে গবেষণার কাজ যেন ওরা ছেড়ে দেয়। ব্যস।’
‘ঠিক আছে। আপনি দেখছি, নাছোরবান্দা ভূত!’
‘কাল অমাবস্যার রাত। রাতের মধ্যপ্রহরে চলে আসবেন বটবৃক্ষের নিচে। একা আসবেন। না আসলে কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়ছি না!’
ভূতটার আর কোনো কথা শোনা গেল না। জটেশ্বর কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ভূতটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেÑ এমন ভাবনা মনে নিশ্চিত হবার পর তিনি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন।
অমাবস্যার রাতে কালীনগর গাঁয়ের লোকেরা বাড়ি থেকে বের হয়- এমন কথা কেউ শোনেনি। কদাচিৎ কেউ যদি বের হয়েও যায়, সে কখনো বটগাছের নিচে আসবে- এমন বুকের পাটা কারো নেই। তান্ত্রিক জটেশ্বরও কখনো বটগাছের সামনে আসেননি। অমাবস্যার রাতে তো নয়ই, কোনো ভরা পূর্ণিমার রাতেও তিনি বটগাছের ধারে কাছে আসেননি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, জটেশ্বরকে অমাবস্যার রাতে বটগাছের নিচে আসতে হল। ভূতের ভয়ে বটগাছকে এড়িয়ে চলতেন তিনি। আজ ভূতের খপ্পড়ে পড়েই তাকে এই বটগাছের নিচে আসতে হল। অমাবস্যার মধ্যরাত ঘন আঁধার ছড়িয়ে রেখেছে। আকাশমুখী বটগাছটিকে আঁধার লেপ্টানো কেমন দৈত্যের মতো লাগছে। বটগাছের ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অনেকগুলো শিকড় নেমে গেছে বটগাছের চারপাশে। অনেক আগাছা-লতাগুল্ম বটগাছের ডালে-শাখায়। গাঢ় অন্ধকারেও ঠাওর করে নিলেন জটেশ্বর। তার বুক দুরু দুরু কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কপাল দিয়ে চিকন একটা ঘাম যেন বেরিয়ে আসছে। জটেশ্বরের গায়ে পাতলা সূতিকাপড়ের গেরুয়া পোশাক। গলায় রুদ্রাক্ষির মালা। কপালে সিঁদুর টিপ। ডানা হাতে ত্রিশূল। নগ্ন পা। জটেশ্বর জানেন ভূত বা এলিয়েনের আক্রমণ এলে ত্রিশূল দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না। তবু মনের মধ্যে লড়াকু ভাব জিইয়ে রাখতে তিনি বাড়ি থেকে ত্রিশূলটা নিয়ে এসেছেন। বটগাছের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি চারপাশে তাকিয়ে ঘন অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখলেন না। জটেশ্বর নিজের ভেতরে ভয়টাকে একটু হালকা করে দিতে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘জয়, মা কালী! কোনো ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না এই জটেশ্বর! কোত্থেকে এল এলিয়েন, সব ব্যাটাকে ধর!’
কণ্ঠটা গমগমিয়ে উঠে গেল যেন বটগাছটার উপরে। কথাও যে গাছে তরতরিয়ে উঠে যেতে পারে, তা প্রথম বুঝতে পারলেন তিনি। কথাটা বটগাছের মগডালে পৌঁছুতেই একদল জোনাক পোকা যেন চক্রকারে নিচে নেমে আসতে লাগল। প্রথমে তার মনে হচ্ছিল শত শত জোনাক পোকা হবে। কয়েক মুহূর্তেই মনে হল হাজার হাজার জোনাক পোকা একের পর এক বৃত্তাকারে নেমে আসছে। এক ঝাঁক বৃত্তকার আলো তাকে ঘিরে ধরল। এতে হচকিয়ে গেলেন তিনি। এ সময় ভূতের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘তান্ত্রিক মশাই, এ কী করলেন! নিজেকে সংযত করুন। এলিয়েনকে ভড়কে দেবার চেষ্টা করবেন না। ওরা ভড়কে গেলে আপনাকেও বজ্রঘাতে মরতে হবে!’
জটেশ্বর কিছু বলতে পারলেন না। অনেকগুলো বৃত্তাকার আলো তার সামনে এসে ঘুরছে। আলোগুলো তাকে ঘিরে যেন নৃত্য করছে। তার বুকের ভেতরের কাঁপনটা বেড়ে গেল। জলের তৃষ্ণা এমন বাড়ল যে, তার মনে হচ্ছিল জল পান করতে না পারলে তিনি এক্ষুণি মারা যাবেন। তাকে ঘিরে আলোর ঘূর্ণন আরও বাড়তে লাগল। তার মনে হতে লাগল আলোর ঘূর্ণিপাকে তিনি কোথাও উড়ে যাবেন হয়তো। জটেশ্বর ত্রিশূলটা তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তার হাত অনড় পাথরের মতো হয়ে আছে। হাত নাড়াতে পারলেন না। ভূতের কণ্ঠস্বর শোনা গেল ফের, ‘চুপ করে থাকলে হবে? বাহাদুরী করেই যখন ফেলেছেন, তখন তা বজায় রাখুন। কিছু একটা বলুন। ওদের সর্দার আছে, তাকে ডাকুন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে এক সময় বজ্রাঘাতের শিকার হবেন, মশাই!’
এ কথায় জটেশ্বরের সম্বিত ফিরে এল। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘কোথায় তোমাদের সর্দার? তাকে ডাকো। আমার চারপাশে চক্কর কাটলেই ভেব না, ভয়ে সেঁটিয়ে যাব। তোমাদের সর্দারকে ডাকো এক্ষুনি!’
এ কথায় আলোর ঘূর্ণি নাচন থেমে গেল। বটগাছে উপর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘কে তুমি? এখানে কেন এসেছ?’
আকাশ পানে তাকিয়ে রাগতকণ্ঠে জটেশ্বর বললেন, ‘আমাদের গাঁয়ে এসে জানতে চাচ্ছ, আমি কে? তার আগে বল, তোমরা কারা?’
‘আমরা এলিয়েন। তুমি?’
‘আমি এই গাঁয়ের তান্ত্রিক। নাম জটেশ্বর। তোমার নাম কী?’
‘আমাদের কোনো নাম হয় না। আমাদের নম্বর দিয়ে ডাকা হয়।’
কথাটা উপর থেকেই এল। গাছের মগডালের দিকে তাকিয়ে জটেশ্বর বললেন, ‘তা নম্বরধারী এলিয়েন, এই বটগাছে ডেরা গেড়েছ কেন জানতে পারি?’
এবার একটা গোল চাকতির মতো আলোময় মুখাকৃতি গাছের উপর থেকে তার সামনে চলে এল। মুখটায় মানুষের অবয়ব থাকলেও পুরোপুরি মানুষ বলা যাবে না। মুখাকৃতিতে লম্বা দু’টি কান আছে। নাক নেই। পুরো শরীর আছে-কি নেই, বোঝা যাচ্ছে না। আলোর চাকতির মুখাকৃতি তার সামনে স্থির। মুখাকৃতি বলল, ‘আমরা এখানে এসেছি তোমাদের নিয়ে গবেষণা করতে।’
কথাটা বলার সময় জটেশ্বর লক্ষ্য করল মুখাকৃতির একটা মুখও আছে, তা কথা বলার সময় শুধু দেখা যায়। জটেশ্বরের ভেতরে ভয়টা যেন ঘুমিয়ে গেছে। বরং এক টুকরো সাহস পেখম ছড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘আমাদের গ্রামেই কেন তোমরা এলে? এখানে গবেষণা করার কী আছে?’
‘মনুষ্য জীবনের নানাদিক নিয়ে আমরা গবেষণা করতে চাই। পৃথিবীর প্রাণীর মধ্যে মানুষ কেন সর্বশ্রেষ্ঠ, এটা জানতে চাই আমরা। এ ছাড়া তোমাদের একদল মানুষ অসম্ভব মেধাবী-জ্ঞানী-প্রতিভাবান। আবার একদল মানুষ হদ্দ বোকা, বেকুব, সহজ-সরল। একদল বিশ্বাসী, আরেক দল ভন্ড-প্রতারক-লুটেরা। একদল মানুষ সৃষ্টিশীল, আরেকদল খুনী। মানুষে-মানুষে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের এত পার্থক্য কেন- এটা জানতে চাই আমরা।’
এ কথার কী জবাব দেবেন জটেশ্বর ভেবে পেলেন না। এমন শক্ত কথার পর কী ধরনের কথা বলা উচিত, তা তিনি রপ্ত করেননি। তিনি একটু ভ্যাবাচেখা খেয়ে গেলেন। আলোর চাকতির মুখাকৃতি যেন মুখ টিপে হাসছে। এ সময় পাশ থেকে ভূত বলল, ‘মানুষের চরিত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে তোমাদের এত আগ্রহ কেন? মানুষ কি তোমাদের আলোর পিদিমের মতো মুখাকৃতি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখিয়েছে? এই যে তোমাদের নাম নেই, শুধু একটা নম্বর নিয়ে পরিচয় বহন করছ, তা নিয়ে কি প্রশ্ন তুলেছে? তোমাদের কান বিশাল আকৃতির আবার নাক নেই, তারপর তোমাদের শারীরিক অবয়বও সব-সময় এক মাপে নির্ধারিত থাকে না, তা নিয়ে কি মানুষ গবেষণা করার কথা ভেবেছে? এখানেই শেষ নয়, তোমরা বাপু, কার অনুমতি নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ? এই যে গাঁয়ের বটগাছটায় আস্তানা গেড়েছ, তা কি আইনসিদ্ধ হয়েছে?’
ভূতের কণ্ঠে ক্ষোভের প্রকাশ। কথা শুনে আলোময় মুখাকৃতির অবয়বে কেমন বিষন্নতা ছেয়ে গেল। জটেশ্বর মনে মনে ভূতের প্রশংসা না করে পারলেন না। এলিয়েনের প্রশ্নের মোক্ষম জবাব দিয়েছে সে। এলিয়েনটা যে একটু ঘাবড়ে গেছে, তা তিনি বুঝতে পারলেন। আলোময় মুখাকৃতিটা একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হল এবং বলল, ‘কে কথা বলল? জটেশ্বর, আমরা তো তোমাকে ছাড়া কাউকে দেখতে পারছি না। তোমার ঠোঁটও নড়েনি। তাহলে কথা বলল কে?’
জটেশ্বর ম্লান হেসে বলল, ‘জনাব এলিয়েন, পৃথিবীতে কি শুধু মানুষেরই বাস? এখানে ভূত-প্রেত-জ্বীন, আরও কত কিছু বাস করে!’
যে বৃত্তাকার আলোগুলো জটেশ্বরকে ঘিরে ছিল, সেই আলোগুলো চারপাশে ঘুরতে লাগল। জটেশ্বরের মনে হল আলোগুলো ভূতটাকে খুঁজছে। আলোকময় মুখাকৃতি ফের বলল, ‘আমরা জানতে চাচ্ছি, এখন যে কথা বলেছে, সে কে?’
জবাব দিল ভূত, ‘আমি কথা বলেছি।’
‘তুমি কে? তোমাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?’
‘আমি ভূত। আমাকে দেখা যায় না।’
‘ভূত! ভূত আবার কী?’
‘ভূত, মানে ভূত!’
‘এই নাম তো আমরা শুনিনি?’
বলল আলোময় মুখাকৃতি। ভূত বলল, ‘সব কথা তোমাদের জানতে হবে কেন?’
‘ভূত আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য কী?’
‘ভূত আর মানুষের বড় পার্থক্য হচ্ছে মানুষ দেখা যায়, ভূত দেখা যায় না। পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব সব-সময় উপলব্ধি করা যায় কিন্তু ভূতের অস্তিত্ব সব-সময় উপলব্ধি করা যায় না। মানুষের স্বপ্ন আছে, আবেগ আছে। জীবন আছে, সংসার আছে। বৈরাগ্য আছে। অনুরাগ আছেও আছে। ভূতের এসব কিছু নেই।’
‘আশ্চর্য! এ কথা আমাদের জানা ছিল না। তা ভূতের কাজ কী? তারা কোথায় থাকে?’
‘ভূতের আবার কাজ কী! ভূতের কাজ করতে হয় না। ভূতের থাকারও জায়গা লাগে না। ভূত হাওয়ায় মিশে থাকে। তবে মানুষের ধারণা ভূতেরা নির্জন এলাকা, ঝোপঝাড়, গাছগাছালী, পুরানো দালান, শ্মশান-কবরস্থানে থাকে।’
‘অতি উৎসাহ পাচ্ছি। ভূত পাওয়া যাবে কোথায়, বলতে পারো?’
এবার জটেশ্বর বলল, ‘জনাব এলিয়েন, ভূত পাওয়া সহজ নয়। ভূত অনেক দুর্লভ। তিনকুড়ি বছর সাধনার পর এই ভূতের সঙ্গে আমার দেখা মিলেছে। অনেক মানুষ পুরো জীবন চেষ্টা-সাধনা করেও ভূতের দেখা পায় না। আর আপনি বলছেন, ভূত কোথায় পাওয়া যাবে। ভূত কি ছেলের হাতের মোয়া? নাকি মেলায় বিক্রি হওয়া পুতুল?’
এ কথায় ভূতটা যেন মুখ টিপে হাসল- চোখে না দেখলেও অনুভব করতে পারলেন জটেশ্বর। আলোময় মুখাকৃতির এলিয়েনটার মুখ ফের প্রশ্নবোধক হল। জটেশ্বর বলল, ‘তা বলছিলাম কি, এই মানুষ-ভূতের পৃথিবীটা ছেড়ে চলে গেলে হয় না? পৃথিবী ছাড়তে মন না চাইলে অন্তত এই গ্রামটা ছেড়ে দিন। আমি হলফ করে বলছি, এই গ্রামের মানুষ খুব সাটামাটা। সহজ-সরল। এরা দিনভর কাজ করে আর সন্ধ্যের পর ঘুমিয়ে পড়ে। এদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বৈচিত্র্য বলতে কিছু নেই। আপনারা ভুল স্থানে এসে গবেষণার কাজ করছেন। গবেষণার নামে আপনাদের সময় নষ্ট হবে আর আমাদের কিছু মানুষ হয়তো মারা যাবে।’
‘কিন্তু আমরা খালি হাতে ফিরে গেলে এলিয়েন রাজ্যে ‘ছিঃ ছিঃ রব’ পড়ে যাবে যে!’
‘তাই বলে…!’
‘আচ্ছা, জটেশ্বর তুমি কি তোমার ভূতটা আমাদের দিতে পারো উপহার হিসাবে?’
‘ভূত চাও! ভূত দিয়ে তোমরা কী করবে?’
‘আরে, ভূতটাই হতে পারে আমাদের গবেষণার বিস্ময়কর বিষয়। ভূত নিয়ে ফিরতে পারলে এলিয়েন রাজ্যে আমাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। বল, ভূতটাকে দিতে পারবে?’
জটেশ্বর বলতে যাচ্ছিল, ‘ভূত আমি দেব কী করে?’ বলতে পারল না। তার কথা বলার আগেই ভূত বলল, ‘আমাকে নিতে হলে একটা শর্ত আছে।’
‘শর্ত? কী শর্ত বল।’
‘শর্ত হচ্ছে তোমরা এরপর আর কখনো এই গাঁয়ে এবং এর চারপাশের ষোল গাঁয়ে আসতে পারবে না। কস্মিনকালেও তোমরা এই গাঁ-গুলোতে গবেষণা চালাতে পারবে না। শর্ত মানলে আমি যাব তোমাদের সঙ্গে।’
‘এ আর তেমন কঠিন শর্ত কি! শর্ত মানলাম।’
‘তাহলে চল।’
‘তোমাকে আমরা নেব কীভাবে? তোমাকে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।’
‘আমি বলে দিচ্ছি, ভূত বলে আমি আলো সহ্য করতে পারি না। তোমরা ঘন অন্ধকার দিয়ে এমন একটি পাত্র তৈরি কর, যেখানে আমি বন্দী হয়ে থাকতে পারি। কাচের বোতল যেমন হয়, তেমনি হলেও হবে।’
‘ঠিক আছে। তৈরি করে নিচ্ছি।’
একটি অন্ধকারের বোতল তৈরি করে ফেলল এলিয়েন। ঐ বোতলে ভূতটা ঢুকে যাবার সময় জটেশ্বরের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘মরে ভূত হয়ে গেছি। এখন ভূত রাজ্যে বাস করলে কী বা এলিয়েনদের রাজ্যে বাস করলেই বা কী! আমার বিনিময়ে সতের গাঁয়ের বাসিন্দারা তো এলিয়েনদের গবেষণার হাত থেকে রক্ষা পেল।’
জটেশ্বরের চোখ দু’টো ভিজে এল। সরলমনা ভূতটার জন্য এই প্রথম তার খুব মায়া হল। এলিয়েনরা ভূতটাকে বোতলবন্দী করে বটগাছ থেকে পাততাড়ি গুটাল দ্রুত। ওরা বটগাছ ছেড়ে যাবার সময় একটা আলোক বল ছুঁড়ে দিল জটেশ্বরের দিকে। বলটা তার দিকে আসতেই বাম হাতে খপ করে ধরে ফেললেন তিনি। বলটা ধরতেই জটেশ্বরের শরীরে একটা হালকা বিদ্যুৎ তরঙ্গায়িত হল যেন। তার শরীরের শিরায়-শিরায় কেমন এক চাঞ্চল্য ঢেউ তুলে গেল। বিস্মিত চোখে পা বাড়াতেই জটেশ্বর টের পেলেন তার ডান পায়ের বাতের ব্যথা নেই। তিনি যখন পা ফেললেন তার মনে হল শরীরে কেমন যৌবনের শক্তি ফিরে এসেছে। বলটা যে রোগ-বালাই শুষে নিতে পারে- এটা বুঝতে পারলেন তিনি। কথাটা ভাবতেই তিনি আলোক বলটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বলটা তার মুঠো ফসকে বেরিয়ে গেল। তিনি বলটাকে ধরতে গেলে বলটাও সমান দূরত্ব রেখে লাফাতে লাগল। তিনি এগুতেই বলটাও লাফাতে লাফাতে এগিয়ে যেতে লাগল। ‘এই বল কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না!’ এমন পণ তার মনে শক্ত হয়ে গেল। তার সামনে বলটা লাফাচ্ছে আর এগুচ্ছে। বলটা ধরতে এক সময় জটেশ্বর দৌড়াতে লাগলেন। বলটাও লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়াতে থাকে। কেউ দেখতে পেল না অমাবস্যার মধ্যরাতে গাঁয়ের পথে জটেশ্বর একটা রহস্যময় বলের পেছনে ঘণ্টায় এক শ’ মাইল গতিতে দৌড়াচ্ছেন। একই সময়ে আকাশ ছাড়িয়ে দূরে এক আলোর মিছিল মিলিয়ে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য অবশ্যই অবিশ্বাস্য!
(অলঙ্করণঃ মামুন হোসাইন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here