প্রায়শই তাঁকে সুপারম্যান মনে হয়…………

0
81

রিমি রুম্মান:

কেমন জীবন সঙ্গী চাই, এমন ভাবনা কিশোরীকালে অনেকের থাকে। আমি চাইতাম, দেখতে যেমনই হোক আমার জামাই হবে নম্র-ভদ্র, শান্তশিষ্ট, প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কেউ। বিয়ের পর দেখলাম, হায় এ কে এসে জুটলো জীবনে! দিন নাই, রাত নাই, পারলে ঘুমের মধ্যেও কথা কয়! অস্হির, চঞ্চল! পুরোটাই আমার বিপরীত।একদিন শাহবাগে কফিশপে ফেনায়িত কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে জানতে চাইলাম, আচ্ছা, তুমি কী দেখে আমাকে পছন্দ করলা? উনি নড়ে চড়ে বসলেন। হাতের শর্মাটি প্লেটে নামিয়ে রেখে সামনে রাখা স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসটি টেনে এক ঢোক পানি গিলে বললেন, দেখলাম চুপচাপ শান্ত স্বভাবের কথা কম বলা একটি মেয়ে …। আমার হাত থেকে খানিকটা কফি ছিটকে পড়ে টেবিলে। মনে মনে বলি, তবে তুমি বাপু এত বকবক করো ক্যারে!🙄 যাক কপালের লিখন! শুরু হয় সয়ে নেয়া জীবন।
যে শুক্রবারে আমাদের যুগল জীবন শুরু, তার পরের শুক্রবারে আমেরিকার উদ্দেশ্যে উড়াল দেই দু’জন। এই দূরের দেশে টোনাটুনি চাকুরি করি, ছুটির দিনে ঘুরে বেড়াই নয়তো টিভিতে মুভি দেখি। যদিও হিন্দি তেমন বুঝি না। চুপচাপ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে ইন্টারেস্টিং অংশটুকুতে জানতে চাই, এইখানে কী বলেছে? উনি কয়েকগুণ উৎসাহিত হয়ে পুরো মুভিটা টেনে শুরু থেকে দিয়ে প্রতিটা ডায়ালগ একে একে বুঝাতে থাকেন। বলেন, শুরু থেকে না বললে তো কিছুই বুঝবা না। আমার মাথা ধরে উঠে। সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণনের সাথে সাথে ঘুরতে থাকে ঘরের মেঝে, ছাদ, আকাশ।
একদা আমাদের টেলিভিশনের যুগ শেষ হয়। ফোনের প্রতি আসক্তি বাড়ে। তিনি হাসির ভিডিও দেখেন। হো হো শব্দে ঘরের দেয়াল কাঁপিয়ে হাসেন রাত বিরাতে। যখন ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তাঁর, ঘুমের ঘোরে হাত থেকে ধুপধাপ নাকে, মুখে, চোখে পড়তে থাকে ফোন। তবুও তা রাখবার কোনো লক্ষণ নেই। কখনোবা ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন আমেরিকানদের জন্যে ভালো, সেইসব বক্তব্য দেন। দিতেই থাকেন। আমি রা করি না। নিজের মতামত ব্যক্ত করে বক্তব্য দীর্ঘায়িত হবার সুযোগ দিতে চাই না। প্রেসিডেন্টের পতনের পর ক’দিন তীব্র মনখারাপের সময় কাটে। শরতের শেষ মেঘের মতো।একসময় শোক কাটিয়ে উঠেন। কাজে যাবার আগে, কাজ থেকে ফিরে গভীর মনোযোগে আবারও ফোন দেখেন নিয়ম করে। আমি আড় চোখে তাকাই।নতুন টপিক বুঝার চেষ্টা করি। দেখি, ইউটিউবে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না শিখতেছে। কয়দিন ধুমধাম বিরিয়ানি রান্না করে। আমার ভাইকে সপরিবারে দাওয়াত দেয়। বন্ধুদের দাওয়াত করে। যা এখনো চলমান…।
নিউইয়র্কের রাস্তায় ড্রাইভিং এ গত এক যুগে আমার কোন দুর্ঘটনা নেই। কিন্তু যার অসংখ্য গাড়ি দুর্ঘটনার নজির, সে-ই আমার গাড়িতে চড়লে ‘ হায় হায় এত জোরে চালাইতেসো ক্যান, এম্নে রাইট টার্ন নিলা ক্যান, অ্যাঁ! তুমি তো মানুষ মারি ফেল্বা… ‘ এমন বিরামহীন মন্তব্য করতে থাকেন। শেষে কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে গলা ছেড়ে গাইতে থাকে, ‘ সেই পাথর চাপা ঝরনাকে আবার, বললে কেনো সময় হলোওও নদী হয়ে যাবার… জানিনা তো কোন মরুতে রাখবে তারে ফেলে… যে ক্ষতি আমি নিয়েছিলাম মেনে…😃
লকডাউনের স্বেচ্ছাবন্দী সময়টাতে পটায়ে তাঁকে দিয়ে পুরো বাড়ির পরিচ্ছন্নতার কাজ করিয়ে নেই। প্রতিটি রুমের দেয়াল, মেঝে, ছাদ এমন ঝকঝকে করেছে, মাশাআল্লাহ…। বিনিময়ে সারারাত জেগে কাজ করার সময়ে পেঁয়াজু, পাকোড়া, ঝালমুড়ি বানিয়ে খাইয়েছি। এতেই খুশি! অল্পতে খুশি হওয়া মানুষেরা মনের দিক দিয়ে ভালো হয়। ভালো ভালো কথা বলে সব কাজ আদায় করে নেয়া যায়।
আমার প্রায়শই তাঁকে সুপারম্যান মনে হয়। বন্ধুদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরবার সময় কখনো যদি গাড়ির চাকা পাংচার হয়, মুহূর্তেই সব কাজ ফেলে ছুটে আসেন। কখনো কোনো ভর দুপুরে ভুলোমনে গাড়ির চাবি ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে দেই যদি, ক্ষুদেবার্তা পাওয়া মাত্রই সুপারম্যান ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে এসে হাজির হয়।
এক কণকণে শীতের রাত। বন্ধুদের সঙ্গে ‘ফাগুণ হাওয়া’ মুভি দেখার সিদ্ধান্ত হয়। আমায় মুভি থিয়েটারের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় সে। মুভি দেখা শেষে ফেরার পথে ভুল ট্রেনে চড়ে বসি। ট্রেন চলছে তো চলছেই। যাত্রীরা উঠছে, নামছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে মগ্ন হয়ে গান শুনছি বিরামহীন। কত সময় পার হয়েছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। একটা পর্যায়ে আবিষ্কার করি ট্রেন প্রায় শুন্য হয়ে এসেছে। যে কয়জন যাত্রী ভেতরে, তাঁরা সকলেই কৃষ্ণাঙ্গ। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় একটা। ভয় ভয় লাগছিল। বুকের ভেতরে তীব্র হাতুড়িপেটা শব্দ টের পাই। ট্রেন থেকে নেমে টোকেন বুথে মিউজিকের তালে তালে শরীর দুলানো বিশালদেহী কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে আমার ভুল গন্তব্যের কথা জানাই। সে পাত্তা দিলো না। হু কেয়ারস ভাব নিয়ে গুনগুণ করে গাইতে লাগলো। সুপারম্যানকে মুঠোফোনে বার্তা পাঠালাম। দ্রুততম সময়ে সে এসে হাজির। বাড়ি ফিরছি। পথিমধ্যে কফিশপে বসে ধোঁয়া উঠা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প হলো। সিনেমার গল্প, বন্ধুদের গল্প। যখন বাড়ি ফিরি, তখন ঘড়িতে রাত তিনটে বেজে পনর।
হোক সে পুরোটাই আমার বিপরীত, তবুও অস্বীকার করার উপায় নেই, সুপারম্যান না থাকলে জীবন চলার পথ এতোটা মসৃন হতো না। তবে বুড়োকালের কথা আগাম বলা যাচ্ছে না।এ নিয়ে কিঞ্চিত শংকিত!
আজ সুপারম্যানের সঙ্গে যুগল জীবনের ২৬তম বছরের শুরু।
ভালো থাকুন। প্রার্থনায় রাখুন।

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here