পাকিস্তানে শুরু হলো শাহবাজ শরীফের যুগ

0
248

বাংলা খবর ডেস্ক:
নাটকের পর নাটক শেষে পাকিস্তানে শুরু হলো শাহবাজ শরীফ যুগের। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এখন আগামী নির্বাচন পর্যন্ত নেতৃত্ব দেবেন পাকিস্তানের। নির্বাচিত হওয়ার পর পার্লামেন্টে দেয়া প্রথম ভাষণে তার যুগ কেমন হবে, কেমন হবে তার কূটনীতি, পররাষ্ট্রনীতি তা স্পষ্ট করেছেন। আরও বলেছেন- বৃটেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে পাকিস্তান। পার্লামেন্টে ভোটগ্রহণ ও গণনা শেষে তাকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত স্পিকার আয়াজ সাদিক। তিনি বলেছেন- ‘মিয়া শাহবাজ শরীফকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হলো।’ পার্লামেন্টে প্রথম ভাষণে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। বলেছেন, পাঞ্জাবের গতিতে সরকার বাস্তবায়ন করবে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর। সদ্য বিদায়ী সরকার চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।

ধন্যবাদ জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টকে। সরকারি কর্মচারীদের সর্বনিম্ন বেতন বাড়িয়ে ২৫ হাজার রুপি নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, এই আদেশ কার্যকর হবে ১লা এপ্রিল থেকে। অর্থাৎ এ মাসের শেষেই তারা এই বেতন পাবেন। তিনি আরও বলেন, ইউটিলিটি স্টোরগুলোতে কম দামে দেয়া হবে গম। তরুণদের দেয়া হবে ল্যাপটপ। চালু করা হবে ‘বেনজির কার্ড’। নতুন এই প্রধানমন্ত্রী বলেন পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। শাহবাজ শরীফ বলেন- পাকিস্তানে যদি অগ্রগতি করতে হয়, তাহলে আর্থিক দিক দিয়ে নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করতে হবে। দেশকে রক্ষা করতে হবে, সম্মান করতে হবে। কাউকেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এই মুহূর্তে তারা বিশ্বাসঘাতক নন। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে, সরকারকে আলোচনা করতে হবে। সব বাধা অতিক্রম করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানকে এগিয়ে নিতে হলে কঠোর কাজ করতে হবে। যদি শুধু বিবৃতি দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হতো, তবে পিটিআইয়ের আমলেই আমরা নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে থাকতাম। একত্রিতভাবে কাজ করে সাবেক সরকারের প্রভাবকে ধুয়ে-মুছে দিতে হবে। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানকে বিনিয়োগের স্বর্গ বানানোর পদক্ষেপ নেবে সরকার। এ খবর দিয়েছে অনলাইন এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, ডন, জিও নিউজ প্রভৃতি।

অন্যদিকে যদিও একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) দল, তবু তারাই এখন বিরোধী শিবিরে। পার্লামেন্টে তাদের আসন ফাঁকা। তারা এখন পার্লামেন্টের বাইরে। বর্জন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন। ওয়াকআউট করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নতুন সরকার ও তার সঙ্গীদের ‘চোর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, চোরদের সঙ্গে তিনি বসতে পারেন না। পার্লামেন্টে এমন এক ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে বিরোধী দলে থাকা জোট। পিএমএলএন, পিপিপি, জেইউআইএফ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ছোট ভাই ও দলীয় প্রধান শাহবাজ শরীফকে। গতকাল রাতেই প্রেসিডেন্টের বাসভবনে তাকে শপথবাক্য পাঠ করানোর কথা প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির।

কিন্তু শেষ মুহূর্তে বলা হয় প্রেসিডেন্ট অসুস্থ। তিনি শপথ পরাতে পারবেন না। চিকিৎসকরা তাকে কয়েকদিন বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এ অবস্থায় স্থানীয় সময় রাত ৯টায় আওয়ানে সদর-এ নতুন প্রধানমন্ত্রীকে শপথ পরানোর কথা সিনেট চেয়ারম্যান সাদিক সাঞ্জরানির। ওদিকে নতুন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা আগেই জানিয়েছেন, পিটিআই সদস্যরা পদত্যাগ করলে সেই আসনে উপনির্বাচন হবে।

গতকাল বিকালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য অধিবেশন বসে। এতে শুরুতে স্পিকারের আসনে বসেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি। তার সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হলে এতে যোগ দেন পিটিআই চেয়ারম্যান ও সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি পার্লামেন্টে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। বলেন, চোরদের সঙ্গে এই পার্লামেন্টে আমরা একসঙ্গে বসতে পারি না। তার সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শাহ মেহমুদ কুরেশি। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদে পিটিআইয়ের প্রার্থী। কিন্তু তারা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের মুখে দাঁড়ান শাহবাজ শরীফ। এই পদে নির্বাচন শুরু হতেই পিটিআই সদস্যরা পার্লামেন্ট বর্জন করেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী পদে সেই ১৭৪ ভোটই পড়ে। এই ভোটেই ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রিত্ব খোয়া গেছে। যদিও পিটিআইয়ের বিরোধী শিবিরের প্রতি সমর্থন ছিল ইমরান খানের পিটিআইয়ের বিদ্রোহীদের, তাদের ভোট দিতে হয়নি। তারা বিরোধীদের লবিতেই এ সময় বসে ছিলেন।
এর আগে ২০১৮ সালে ইমরান খান যখন ১৭৬ ভোট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখনও এ পদে প্রার্থী ছিলেন শাহবাজ শরীফ। তিনি তখন পেয়েছিলেন মাত্র ৯৬ ভোট। এবার এ পদে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পিটিআইয়ের শাহ মেহমুদ কুরেশি। কিন্তু এ দলটি পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নতুন শাসকগোষ্ঠীকে আমদানি করা আখ্যায়িত করে পার্লামেন্টের শেষ মুহূর্তে তা বর্জন করে। এ সময় পিটিআইয়ের এমপিরা পার্লামেন্ট থেকে বের হয়ে যেতে থাকেন। তারা তাদের বিরোধী দলগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে পিটিআইয়ের এমপিরা পার্লামেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত স্পিকার আয়াজ সাদিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করেন। আকস্মিকভাবে তিনি শাহবাজ শরীফকে ভুল করে নওয়াজ শরীফ হিসেবে উচ্চারণ করেন। পরে শাহবাজ শরীফের কাছে এ জন্য ক্ষমা চান। তিনি বলেন, নওয়াজ শরীফ তার হৃদয় ও মননে আছেন বলে এমন ভুল করে ফেলেছেন। অতঃপর শাহবাজ শরীফকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণার পর (সাবেক) বিরোধী দলের সদস্যরা ট্রেজারি বেঞ্চে গিয়ে বসতে শুরু করেন। এ সময় উভয় পক্ষেরই অনেক আসন ফাঁকা ছিল। অন্যদিকে অনেকেই যেখানে বসেছিলেন, সেখানেই স্থির থাকেন।

পার্লামেন্ট শুরুর দিকে পিটিআই থেকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেয়া প্রার্থী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি ঘোষণা দেন যে, পিটিআইয়ের এমপিরা পার্লামেন্ট থেকে একযোগে পদত্যাগ করবেন। পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরির সভাপতিত্বে অধিবেশন চলতে থাকে। এ সময় তিনি ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট না দেয়ার বিষয়ে এবং তার সম্পর্কের বিষয়ে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, এর আগে পার্লামেন্টের দেয়া আদেশকে আদালত অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছে। আমরা আদালতের আদেশের প্রতি সম্মান দেখাতে বাধ্য। কিন্তু আমার রুলিং সম্পর্কে আপনাদের সামনে কথা বলতে চাই। একজন দায়িত্বশীল পাকিস্তানি এবং পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার হিসেবে তিনি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে জানান। এরপরই ডেপুটি স্পিকার সহ পিটিআইয়ের সদস্যরা একযোগে পদত্যাগ করার ঘোষণা দেন। ফলে ভারপ্রাপ্ত স্পিকার পিএমএলএনের নেতা ও সাবেক স্পিকার আয়াজ সাদিকের সভাপতিত্বে পার্লামেন্ট চলতে থাকে।

রোববার রাতে পিটিআইয়ের বড় রকম পাওয়ার শো সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলে ইমরান খান বলেন- ‘ইজ্জত দেনেওয়ালা আল্লাহ হ্যায়’। অর্থাৎ সম্মান দেয়ার মালিক আল্লাহ। ওদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের এমপিদের একযোগে পদত্যাগের খবরে সয়লাব। নানা প্রতিকূলতা ও নাটকীয়তা শেষে পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে।

সরকারি দল ও বিরোধীদের মধ্যে শনিবার শুরু হওয়া অচলাবস্থা প্রায় ১৪ ঘণ্টা চলতে থাকে। এরপর আইনি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান। সোমবার স্থানীয় সময় বিকাল দু’টায় নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার অধিবেশন বসার কথা থাকলেও তা শুরু হয় বিলম্বে।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এদিনই প্রথমবার পার্লামেন্টে উপস্থিত হন ইমরান খান। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগেই তিনি পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। জানিয়ে দেন তিনি চোরদের সঙ্গে পার্লামেন্টে বসবেন না। ইমরান খান পার্লামেন্টে বলেন- যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১৬০০ কোটি রুপির একটি এবং ৮০০ কোটি রুপির আরেকটি দুর্নীতির মামলা আছে, তাকে নির্বাচিত করা হচ্ছে, তাকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হচ্ছে। দেশের ওপর এর চেয়ে বড় অপমান আর হতে পারে না। তার এ সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করেন ইমরান খান সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ। তিনি বলেন, পার্লামেন্টে বসে থাকলে তাতে বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরীফকে শক্তিশালী করা হবে। তাই তারা জাতীয় পরিষদ হিসেবে পরিচিত পার্লামেন্টে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, দলের পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে আমার পরামর্শ সমর্থন করেছেন ইমরান খান। তিনি বুধবার পেশোয়ার সফরে যাবেন। প্রতি রোববার জনগণকে বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার ডাক দেবেন ইমরান। ওদিকে এআরওয়াই নিউজের খবর অনুযায়ী, পার্লামেন্টে প্রথম পদত্যাগপত্র জমা দেন পিটিআইয়ের সদস্য মুরাদ সাঈদ।
দিনের শুরুতে রাজধানী ইসলামাবাদে পার্লামেন্ট হাউজে পাল্টামেন্টারি দলের মিটিং করে পিটিআই। রেডিও পাকিস্তান এ খবর দিয়ে বলেছে, ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ইমরান খান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here