আমার আব্বা

0
588

রাজু আহমেদ

আমাদের ছোটবেলায় আব্বা থাকতেন চট্টগ্রামে।একদা ধনীর দুলাল হলেও জীবনের বাকবদলেে আমাদের মানুষ করতে আব্বাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সে এক বিরাট ইতিহাস। কাজিরগাঁওয়ের মফিজউদ্দীন বেপারীর (আমার দাদা) উত্থান-পতনের সেই ইতিহাস এক সময় লেখা যাবে। আজ শুধুই আব্বাকে নিয়ে দু’-চার কথা……
চট্টগ্রাম থেকে দু’ মাস, চার মাস পর বাড়ি আসতেন। সেই দিনের জন্য আমাদের কতো অপেক্ষা…। ভাই-বোনদের একে অন্যের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ, সব বিচার-আচার জমিয়ে রাখতাম আব্বার অপেক্ষায়। সেই সময় মোবাইল ফোন ছিল না। আব্বা ডাকযোগে কখনো চিঠি পাঠিয়েছেন- এমনটাও মনে পড়ে না। গ্রামের বা আশ-পাশের গ্রামের কেউ চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি এলে তার মাধ্যমে টাকা, চিঠি বা খবর পাঠাতেন। ফলে আব্বা বাড়ি আসবেন- সব সময় এই খবরটা অগ্রিম পাওয়া যেতো না। আগে খবর পেলে সেই দিনটির জন্য উদগ্রিব হয়ে থাকতাম আমরা। আর হঠাৎ আব্বা চলে এলে তো কোনো কথাই নেই…কে কার আগে তাঁকে ধরবো তা নিয়ে চলতো তীব্র প্রতিযোগিতা। ‘আব্বায় আইছে‘..‘আব্বায় আইছে’ চিৎকারে আশপাশের কয়েক বাড়িতে জানাজানি হয়ে যেতো তাঁর আগমন বার্তা। প্রথম দু’একদিন খেলাধূলা ভুলে আব্বার পাশে থাকার চেয়ে আনন্দের আর কিছুই ছিল না। রাতে আব্বার পাশে ঘুমানো নিয়ে তো রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে যেতো।
যে ক’দিন থাকতেন বাড়ি আর বাজার ছাড়া খুব বেশি জায়গায় যেতেন না। কী এক অভিমানে আব্বা অনেক কাল তার কোনো চাচা বা অন্য কারো ঘরে যেতেন না। আমাদের বাড়ির একপাশে আব্বার নানার বাড়ি, আরেক পাশে আমাদের নানা বাড়ি। এই দুই বাড়িতেও আব্বাকে দু’-একবারের বেশি যেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
যে অবস্থায় হোক, আব্বা কখনো কারো মুখাপেক্ষী হতে পছন্দ করতেন না। সব সময় বলতেন, ‘পরেরডার লোভ করিস না’। ‘সব সময় আদব, বুদ্ধি, মহব্বত ও সাহস নিয়ে চলবা’- এই উপদেশ যে কতোবার দিয়েছেন! অসৎ উপার্জন সম্পর্কে সব সময় সতর্ক করেছেন। বলতেন, ‘যত কষ্টই হোক, হারাম খাইস না..।’
যতো বড় হয়েছি দিনে দিনে আব্বার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। জীবন বাস্তবতায় একই শহরে দুই এলাকায় থাকতে হলেও অস্তিত্বের গভীরে সব সময় ছিলেন আমার আব্বা। দূরে থাকলেও প্রতিদিন নানা অভিযোগ-অনুযোগ জানিয়েছি আব্বার কাছে। তিনি ছিলেন একটা বিরাট ভরসা। পৃথিবীতে তার উপস্থিতি ছিল একটা বিরাট শক্তি।
২০১৫ সালের ৭ মে গভীর রাতে হঠাৎ করেই চিরতরে চলে গেছেন আব্বা। সেইসঙ্গে কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে সেই শক্তিটা। যতো কিছুই করি না কেনো কেমন যেনো অসহায় মনে হয়। পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে বিরাট একটা ভরসার জায়গা।
অনেক কথা জমে আছে, বলতে পারি না। একমাত্র আব্বাকেই বলা যায় এসব কথা। আব্বা ছাড়া আর কারো কাছ থেকে সঠিক সমাধান পাবো, ন্যায়বিচার পাবো কিংবা বুকের ভারটা অন্তত নেমে যাবে- এমন ভরসা আর কারো কাছে পাই না।
……………………………………………
আজ ৭ মে আমার আব্বার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here