আমার মানবতাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে

0
142


ফাহমিদা পলি:
না… আমার কোন পুলিশ বা মানবাধিকার কর্মী র প্রয়োজন পড়েনি। আমার মানবতাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। আমার পাশের বিল্ডিং এর এই শিশু গৃহকর্মী টি দীর্ঘ দেড় বছর আটক অবস্থায় ছিল। ওর বাবা নাই, মা অন্যত্র বিয়ে করে সন্তান সন্ততি, ঘর সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। ওর খালা এনে এক ডাক্তার দম্পতি র কাছে ওকে দেয়। স্ত্রী ডাক্তার,স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। মেধা এবং নাগরিক হিসাবে সমাজে এরা এক নম্বর। সভ্য সমাজ তাদের পক্ষে। তারাই সমাজের ধারক, বাহক।গত সপ্তাহে আমার বাসার ছুটা বুয়া আফসোস করে বললো বাচ্চাটার করুন কাহিনি। সে রোজ ওই বাসায় কাজ করতে গেলে বাচ্চাটার উপর অমানবিক অত্যাচার দেখে নিরবে চোখের পানি মুছে বেরিয়ে আসে।ওর মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হয়না দীর্ঘদিন। মায়ের সকল মোবাইল নাম্বার ডাক্তার ম্যাডাম ব্লক করে রেখেছেন। মা এবং মেয়ের বিচ্ছেদ এবং যোগাযোগের সকল পথ বন্ধ। যে খালা ওই বাসায় দিয়েছিল সে বারংবার ম্যাডাম কে অনুরোধ জানায় বাচ্চাটিকে এক বার তার মায়ের কাছে দিতে। পরবর্তীতে সেই খালাকে পুলিশের ভয় দেখায় এবং বাচ্চাটিকে ভয় দেখায় বাড়ী যেতে চাইলে ফুটবলের মত লাথি মেরে মেরে ওকে মেরে ফেলবে । আতংকিত শিশুটি কি জানি হয়তো জীবনের স্বাদ বুঝে গিয়েছিল,তাই সে শেখানো কথাই বলতে থাকেযে আমি বাড়ী যাবোনা। গল্প শুনে বুকের কোথায় যেন হু হু করে উঠলো।



ফ্ল্যাট নাম্বার, বিল্ডিং নাম্বার জানতে চাইলাম অবচেতন মনেই। মায়ের ফোন নাম্বার জোগাড় করে যোগাযোগ করলাম, মা কান্নায় তোড়ে কথাই বলতে পারছে না! সারারাত ঘুম হলোনা।ভাবতে বসলাম আমি আর সেই ডাক্তার ম্যাডাম তো সমাজের উচু এবং অভিজাত শ্রেনীর, কি জানি উপর দিকে থু থু মারলে নিজের মুখেই এসে পড়ে কিনা! ওরা নীচ, ছোটলোক, ইতর শ্রেনী… ওদের পাশে দাড়ালে সেই ছোড়া থুথু টা নিজের মুখেই পড়ে কিনা। থুথু উপেক্ষা করে শূন্য হাতে কোমড় বেধে নামলাম মাঠে। একবার ভাবলাম মানবাধিকার কোন সংস্থার সাহায্য, বা নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে যাবো কিনা। নাহ! দায়িত্ববোধ কোথায় যেন কষাঘাত করলো। আমি না শিক্ষিত, সচেতন!!! মানবতা কি কেবল মানবাধিকার কর্মীদের থাকে? আমার থাকতে পারেনা? বাচ্চা টার খোজ রোজ নেয়া শুরু করলাম। ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই ও আমার আপন হয়ে উঠলো। জানলাম ও আর দশটা শিশুর মত নয়। ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চা। অকারনে হাসে, খেলে, যা শিখিয়ে দেয়া হয়,তাই আওড়াতে থাকে। অথচ কাজে সুনিপুণ! যাদের এই শিশুদের প্রতি নূন্যতম ধারনা আছে, তারা জানেন যে কোন কাজে তারা কেমন মনোযোগী হয়। ওতোটুকু শিশুকে দিয়ে তারা ঘরের সকল কাজ করায়। বাসায় সি সি ক্যামেরা থাকায় অফিসে থেকে বসেই ম্যাডাম পান থেকে চুন খসলেই খিস্তি করে ওঠেন। বাড়ী ফিরেই শুরু হতো নির্মম নির্যাতন! খাবারো তিন বেলা ঠিক মত জুটতোনা অভাগীর, অপুষ্টিতে হাড্ডিসার শরীর!!!

বিল্ডিং কমিটি কে জানালাম বিষয় টি,যাতে মান সম্মান বজায় রেখে বাচ্চা টিকে তার মায়ের কাছে হস্তান্তর করে। আবার সেই উচু শ্রেনী এক হলো। স্বহস্তে অভিযোগ লিখলাম। শুরু হলো ধানাইপানাই। কোন ভাবেই শিশুটিকে হস্তান্তর করবেনা, তার মত নিরাপত্তা নাকি তার মা কেন দুনিয়ার কেউ দিতে পারবেনা। জিদ চাপতে থাকলো,মাথায় রক্ত উঠে গেল আমার। আমিও নাছোড়বান্দা। কমিটির সাথে উত্তপ্ত বাক্যালাপের এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার পুলিশ, মানবাধিকার এবং মিডিয়া এক সাথে ডাকবো এবং আজ দুপুর ১২ টা পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিলাম। এক দিকে সভ্য, সুশীল সমাজ অন্যদিকে আমি নীচ এবং ইতরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে। ক্রোধে, ক্ষোভে ফেটে পড়ছি, হ্যা আমি ইতর! আমি নীচ! আমি আপনাদের মত ভদ্র সমাজের বাসিন্দা হতে চাইনা। আমাকে নির্বাসন দিন!!!

নির্বাসিত আমি শিশু তামান্নার হাত ধরে উঠে এলাম আমার ফ্ল্যাটে। আঘাতের চিহ্নগুলোতে হাত বুলিয়ে নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, ক্ষমা করে দিস মা। এই সমাজে তোর মত শিশুরা ধর্ষিত হয়, নির্যাতিত হয়! এ সভ্য সমাজ তোদের চাইতেও নীচ!
তোদের চাইতেও ইতর!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here