প্রতারণার নতুন কৌশল মোবাইল স্পুফিং

0
578

মেজর (অব.) সুধীর সাহা:
কানাডা-আমেরিকার গল্প দিয়েই শুরু করি। প্রবাদ আছে- প্রতারক সব জায়গায়, সব সময় একই রূপ ধারণ করে। কানাডা হোক, আমেরিকা হোক আর বাংলাদেশই হোক- প্রতারকের ধর্মই প্রতারণা করা। কানাডায় একদল প্রতারক আছে যারা টেলিফোনের মাধ্যমে প্রতারণা করে।

বিশেষভাবে টেলিফোন নম্বরের মালিকের নাম দেখে যখন তারা বুঝে নেয় এশিয়ার কোনো দেশের মানুষ হবে, তখন তারা বেশি উৎসাহিত হয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে চায়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চীন এসব দেশ থেকে আগত কানাডিয়ান ইমিগ্র্যান্ট অথবা নাগরিক খুবই কম পাওয়া যাবে, যারা এ প্রতারকদের কখনও কোনো টেলিফোন পায়নি। এ প্রতারক চক্র সাধারণত কানাডা থেকে ফোন করে না; ফোন করে ভারত-পাকিস্তান থেকে। কিন্তু তাদের নম্বরটা প্রদর্শিত হয় কানাডার রাজধানী অটোয়া কিংবা টরেন্টোর নম্বর হিসেবে। ফোন ধরলেই শোনা যাবে- ইমিগ্রেশন, ট্যাক্স কিংবা ক্রিমিনাল বিষয়ে ওই ব্যক্তির মামলা আছে।

আরও বলবে- তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে; পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে আসছে একটু পরই। যদি রক্ষা পেতে চায়, তবে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভয়ে যদি একবার কথা শুরু করে, তবে আর রক্ষা নেই। প্রতারকরা অভিনব কায়দায় ওই ব্যক্তিকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে।

কানাডায় নতুন গেছে এমন এক মেয়ে এমন প্রতারকের পাল্লায় পড়ে তার ব্যাংকে যত টাকা ছিল সব তুলে প্রতারকের নির্দেশ অনুযায়ী পাঠিয়ে দেয়ার পর বুঝতে পেরেছিল সে প্রতারণার শিকার হয়েছিল। কানাডায় এমনভাবে টেলিফোনে প্রতারণার বিষয় খুবই কমন। পুলিশকে বললে তারা হাসে। তাদের নম্বরেও তারা কখনও কখনও প্রতারকের এমন ফোন পায়। তারা তাই পরামর্শ দেয়- উপেক্ষা কর। তাদের ধরার বিশেষ কোনো উপায় নেই।

কেন না তারা অবস্থান করছে ভারত বা পাকিস্তানে এবং স্পুফিংয়ের মাধ্যমে তারা নম্বরটি শো করছে কানাডার নম্বর হিসেবে। এমন একটি প্রতারক চক্রকে আবিষ্কার করেছিল ভারতীয় পুলিশ দিল্লির একটি কল সেন্টারে। এ প্রতারক দল ভারতে অবস্থিত ওই কল সেন্টার থেকে কানাডার বিভিন্ন নম্বরে মোবাইল স্পুফিংয়ের সাহায্য নিয়ে কল করে প্রতারণা করত।

আধুনিক পদ্ধতির এ প্রতারণার ফাঁদ থেকে বাংলাদেশও বাদ যায়নি। বাংলাদেশের চতুর প্রতারকের দল এখানেও এমন অভিনব পদ্ধতিতে লোক ঠকাচ্ছে। হ্যালো, আমি ওসি বলছি; হ্যালো, আমি ডিসি বলছি; হ্যালো, আমি এমপি বলছি। কল পাওয়া লোকটি তো হুমড়ি খেয়ে পড়বেই। প্রথমে বিশ্বাস না হলেও তারা যখন দেখে আগত নম্বরটি সত্যি সত্যি কোনো সরকারি কর্মকর্তার নম্বর, তখন তো তারা ধরাশায়ী হয়ে পড়বেই।

এমন ঘটনাই এখন বাংলাদেশের চমৎকৃত প্রতারণার গল্প, বিশেষ করে গত সিটি নির্বাচনে ফাঁদে পড়েছিলেন তিন কাউন্সিলর প্রার্থী। এ তিন প্রার্থীর কাছ থেকে খসে যায় ১৭ লাখ টাকা। প্রথম ফোন আসে স্থানীয় থানার ওসির নম্বর থেকে। হ্যালো, আমি ওসি বলছি। সেই তথাকথিত ওসি সাহেব তখন ওই অঞ্চলে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নম্বর দিয়ে জানিয়ে দেন, সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর প্রার্থী ইচ্ছা করলে ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। টেলিফোন পাওয়া প্রার্থী যখন চিন্তার বিশাল সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তখন আবার আসে আরও একটি টেলিফোন। এবার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নম্বর (তথাকথিত ওসি যে নম্বরটি প্রদান করেছেন) থেকে।

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ফোন পেয়ে ব্যক্তিটি পরশপাথরের ছোঁয়ায় যেন একেবারে বোবা বনে যান। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সোজাসুজি অফার- প্রার্থী সাহেব, পাস করতে চান কি? আমরা মিলেমিশে আপনাকে পাস করিয়ে দিতে পারি, যদি আপনি তা চান।

প্রার্থীর সামনে তখন চাঁদ ধরা দেয় আর-কি! কী বলবেন, কী ভাববেন- যেন কিছুই স্থির করতে পারেন না। হতভম্ব অবস্থা। অপরপক্ষ এ অবস্থা বুঝতে পারে। সময় দেয়া তাদের ধর্মবিরোধী কাজ। তাদের ধর্ম এবার লাফিয়ে ওঠে দ্রুত। তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে বলে প্রার্থীর মতামত।

তা না হলে তারা অন্য প্রার্থীকেই জিতিয়ে দেবেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ভারিক্কি চালে বলে যান- ওসি সাহেবকে জানিয়ে দেবেন দ্রুত, অন্যথায় আমরা অন্য প্রার্থীকে জেতাব বলেই ফোনের লাইন কেটে দেন। প্রার্থীর অবস্থা তখন একেবারেই দিশেহারা। হাতের মুঠোয় যেন ময়ূর সিংহাসনের হাতছানি। ভাবতে থাকেন ওসিকে কি ফোন দেবেন? অন্য কারও সঙ্গে কি পরামর্শ করবেন? ভাবতে ভাবতেই আবার ক্রিং ক্রিং ক্রিং। ওসি সাহেবের ফোন আবার। সময় নেই তাদের, এখনই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। অন্যথায় অন্য প্রার্থীর জয়।

প্রার্থী যেন পাগলই হয়ে যাবে। তাৎক্ষণিকভাবে বলে বসেন, আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। তারপর দাম-দর হয়, প্রার্থীর জমানো অর্থের একটি বড় অংশ উজাড় করে ঢেলে দেন তথাকথিত ওসি/ম্যাজিস্ট্রেটের চরণতলে। সব শেষ হয়ে গেলে এক সময় প্রার্থী বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারক চক্রের শিকার হয়েছিলেন। মোবাইল স্পুফিংয়ের আধুনিক ক্ষতিকারক টেকনোলজি দিয়ে প্রতারক চক্র তার পকেটের টাকা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। প্রলোভনে, লোভে অন্ধ হয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী তখন সব হারানোর বেদনায় শুধু হাহাকারই করতে পারেন।

স্থানীয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে এ মোবাইল স্পুফিংয়ের প্রতারণার অভিনব পদ্ধতির বিষয় জানতে পারি। বিশেষ করে, অধুনা হয়ে যাওয়া দুই ঢাকা সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীদের কাছ থেকে মোবাইল স্পুফিংয়ের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি প্রতারণার খবর জানতে পারলাম।

তুমি চলবে ডালে ডালে, আমি চলব পাতায় পাতায়- যেন এমনই অবস্থা। প্রতারণার জাল বুনেই যাচ্ছে প্রতারক চক্র। এক পদ্ধতি ধরা পড়লে, অন্য পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করে ফেলে। তাদের সর্বাধুনিক আবিষ্কার বুঝি এ মোবাইল স্পুফিং। মোবাইল স্পুফিংয়ের মাধ্যমে টেলিফোন নম্বর প্রতারণা করার সুযোগ রয়েছে; অর্থাৎ ফোনদাতা যে নম্বর থেকে ফোন করছে ফোন গ্রহীতার কাছে সেই নম্বরটি শো না হয়ে ভিন্ন কোনো নম্বর শো হবে। প্রতারক এই সুযোগটি গ্রহণ করে যে কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারি কর্মকর্তার নম্বর বলে ফোন করে বসে নিরীহ কোনো ব্যক্তিকে। কোনো গ্রহীতা ভাবছে ঊর্ধ্বতন কোনো সরকারি কর্মকর্তা কিংবা জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে ফোন এসেছে। প্রতারক চক্র তখন এ নতুন প্রতারণার ফাঁদে ভালোভাবেই আটকে ফেলে ফোন গ্রহীতাকে।

সংবাদপত্রের রিপোর্টে প্রকাশ, গত আড়াই বছরে পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তার মোট ৮১১টি নম্বর স্পুফিং করে প্রতারণা করার ঘটনা রিপোর্ট হয় পুলিশের কাছে। গত সিটি নির্বাচনে মোহাম্মদপুর এলাকার তিন কাউন্সিলর প্রার্থীর কাছ থেকে মোট ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল প্রতারক দল। মোহাম্মদপুর থানার ওসি এবং আদাবর থানার ওসির মোবাইল নম্বর স্পুফিং করে প্রতারণার শিকার করা হয়েছিল এ তিন কাউন্সিলর পদপ্রার্থীকে। টাকা প্রদানের পর তারা জানতে পারেন, তিনজনই প্রতারক চক্রের জালে বাঁধা পড়েছিলেন। মোবাইল

স্পুফিংয়ের প্রতারক দল একটি বিষয় খুব সাবধানতার সঙ্গেই করে থাকে। তারা টার্গেট ব্যক্তিকে পর্যাপ্ত সময় দেয় না চিন্তা করার বা খোঁজখবর নেয়ার। পরপর ফোন করে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। আগত ফোন নম্বরে ফিরতি কল দিলেই কিন্তু প্রতারকদের প্রতারণা করার সুযোগ থাকে না।

প্রযুক্তিটি শুধু ছদ্ম কোনো ফোন নম্বর শো করতে পারে, কিন্তু কল পাওয়ার পর যদি কলপ্রাপ্ত ব্যক্তি কল ব্যাক করে, তাহলে সেই কলটি চলে যাবে আসল ব্যবহারকারীর কাছে- প্রতারকের কাছে নয়। সুতরাং এমন প্রতারক দলের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হল- যে নম্বর থেকে কল আসছে, যা শো করছে কোনো সরকারি কর্মকর্তার নম্বর, দ্রুত সেই নম্বরে কল ব্যাক করা।

মোবাইল স্পুফিং করে চাঁদাবাজি ঠেকাতে নতুন কোনো ডিভাইস এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে যে কোনো সময় আমরা নিশ্চয়ই শুনব- এমন একটি টেলিফোন সেট আবিষ্কৃত হয়েছে, যে বলবে কলারের আইডেনটিটি নকল। ততদিন পর্যন্ত কল গ্রহণকারীকে সঠিক কল কি না, তা নিশ্চিত হতে কল ব্যাক পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে। কানাডা-আমেরিকায় ঠকবাজরা এমন ধরনের প্রতারণা করতে তেমন কোনো সুযোগ পায় না। কেন না, সেখানে কল ব্যাক করাও যায় না। কল ব্যাক করলে বলে দেয় নম্বরটি ভুল আছে।

অথবা কোনো নম্বরই ওঠে না টেলিফোনে। একটু সতর্ক হলে কল গ্রহণকারী খুব সহজেই বুঝতে পারেন কলটি প্রতারকদের কাছ থেকে এসেছে। তবে সমস্যা ওইসব দেশে আগত নতুন লোকদের জন্য। তারা টেলিফোন ধরলেই ভয় পেয়ে যায়; আর গড়গড় করে গোপন কিছু তথ্য দিয়ে বসেন প্রথমেই। তারপর প্রতারকদের নির্দেশিত পথেই তাকে হাঁটতে হয়। প্রতারকরা ভারত কিংবা পাকিস্তানে বসেই কানাডায় অবস্থিত সরল কোনো মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে সর্বস্বান্ত করার প্রয়াস পায়। বেশ বোকা না হলে সেখানে ফাঁদে পড়ার ভয় খুব থাকে না।

কেননা সেখানে সহজেই ধরা যায় কোনটি আসল ফোন আর কোনটি প্রতারকদের ফোন। তবে সেখানে স্পুফিংয়ের অন্য একটি সমস্যা হল, ফোন কলটি যদি অটোয়া কিংবা টরেন্টোর ফোন নম্বর শো করে এবং সে অনুযায়ী কল ব্যাক করলে সেই কলটিও ভারত কিংবা পাকিস্তান কিংবা নাইজেরিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশে চলে যায়। প্রতারকরা তখন কানাডার কোনো সরকারি অফিস হিসেবে পরিচয় দিয়ে কল ব্যাককারীকে ধোঁকা দিতে পারে না।

তবে আশার কথা হল, প্রথমদিকে কিছু লোক প্রতারণার শিকার হয়ে গেলে ওদের দেশের অন্য লোকজন সতর্ক হয়ে যান। এ ধরনের কোনো কলে তারা এখন আর অ্যাটেন্ড করেন না। বেশ কিছু ঘটনার রিপোর্ট হলে কানাডার আরসিএমপি সূত্র ধরে ধরে এক সময় ভারতের দিল্লিতে এমন এক ধরনের চক্রের সন্ধান আবিষ্কার করে দিল্লি পুলিশকে জানালে দিল্লি পুলিশ ওই কল সেন্টারের অনেক কলকারীকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থাটি কিছুটা ভিন্নতার দাবি রাখে। এখানে ওসি, ডিসি কিংবা সরকারি কোনো কর্মকর্তার নম্বর থেকে কোনো ফোন কল এলে ফোন রিসিভার যদি বুঝতে পারেন যে নম্বরটি কোনো সরকারি কর্মকর্তার, তবে সেই কলটি উপেক্ষা করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব। প্রতারকরা এ সুযোগটাই গ্রহণ করে। সময় না দিয়ে কিংবা কল ব্যাক করার সুযোগ না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তারা কল রিসিভারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করে নিতে চেষ্টা করে। তবে কল রিসিভার যদি একটু বুদ্ধি করে কল ব্যাক করে, তবেই কিন্তু বোঝে যে কলটি প্রতারকদের কাছ থেকে এসেছিল। কেননা, কল ব্যাকের কলটি আসল কর্মকর্তার কাছেই যাবে।

প্রতারকদের ধর্ম শুধু প্রতারণা করা। বাংলাদেশেই হোক, কানাডায়ই হোক- প্রতারকদের চরিত্র একই রকম। কাল-স্থানভেদে শুধু পদ্ধতির পার্থক্য থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু মোবাইল স্পুফিংয়ের টেকনোলজিতে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে, তাই জনগণকে সতর্ক হতেই হবে। প্রতারকরা এ পদ্ধতি লুফে নেবে এবং বিবিধ পন্থায় এর ব্যবহার শুরু করবে। ভুক্তভোগী সতর্ক হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

তবে সরকার যদি একটু বেশি তৎপর হয়, যদি যত্রতত্র মোবাইল ফোনের সিম বিক্রির ব্যবস্থা বন্ধ করা যায়, সিম বিক্রির ক্ষেত্রে যদি রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থা পাকাপাকি করা যায়, তবে এসব প্রতারকরা হয়তো বা পথ খোলা না-ও পেতে পারে।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here