অন্তুর বিয়ে খাওয়া

0
587


নার্গিস আখতার কনক

অন্তুর আজ বড্ড খুশি লাগছে। কারণ, তার বড় মামার বড় ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। এই সামনের গ্রীষ্মে। অন্তুর পাঁচ খালা ও পাঁচজন মামা। নানিরা ছিল জমিদার বংশের। তাই গ্রামে তাদের সবাই খুব সম্মান করে। অন্তুর বড় মামা ও সেজ খালা গ্রামে থাকে। অন্তুরা থাকে রাজশাহীতে। অন্তুর নানি ও খালাদের সমাদরে গ্রামের মধ্যে দাসদাসীর অভাব ছিল না। অন্তুর মামাতো ভাইয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। এত দিন ভালো চাকরি পাচ্ছিল না বলে ভালো বিয়ে হচ্ছিল না। আজকাল চাকরি ছাড়া কি ছেলে কেউ দেখে? যা হোক, অনেক কষ্টে একটা শিক্ষিত মেয়ে পাওয়া গেছে। মেয়ের পরিবার অন্তুদের তুলনায় গরিব। আজকাল জমিদারি প্রথা উঠে গেছে বলাই চলে। তাই শিক্ষিত হওয়ার ধুম পড়েছে। মেয়ের বাবা আগেই বলেছে, তারা কিছু দিতে পারবে না। তাদের সামর্থ্য কম। অন্তুর নানিরা খুব সততা দেখালেন যে, না দিলেও তাদের কিছু আসে যায় না, তারা যে একটা শিক্ষিত মেয়ে পেয়েছে, এতেই খুশি। অন্তু বিয়ে নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা করতে লাগল। বিয়েতে তার প্রিয় খালাতো, মামাতো বোনেরা আসবে। আরও আত্মীয়স্বজন আসবে। রাজশাহীতে আরেকজন মেজ খালা থাকে। কিছুদিন আগে অন্তুর মেজ খালার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষা থাকায় অন্তুর খালাতো, মামাতো বোনেরা আসতে পারেনি। অন্তুকে একা একা থাকতে হয়েছিল। তাই সে ভাবল, এবার সবার সঙ্গে দেখা হবে গ্রামে গিয়ে। কিন্তু না, এবার আরও করুণ অবস্থা, এই গ্রীষ্মের গরমে অনেকেই আসতে চাইছেন না। মামাদেরও একই অবস্থা। শুধু দূর থেকে অভিনন্দন জানাবেন। তবে মামারা না এলেও কী হবে, অন্তুর খালারা পাঁচ বোন ঠিকই গেল গ্রামে। বিয়েতে অন্তুর একটা খালাতো বোন মৌ আপুও এল এক বছরের বাচ্চা কোলে। অন্তুর একা একা একদম ভালো লাগছে না। অনেক দিন পর অন্তুর মা-খালারা একত্র হয়েছে। তাই সন্ধ্যার সময় বসে গল্পের আসর। অন্তু সেই আসরের এক কোণে বসে চুপচাপ গল্প শুনছে। মেয়ে এক ছোট ঘরের বলে নানিদের ভাবখানা আর কে দেখে! পরের দিন বিয়ে, তাই রাতে চলছিল বাক্স সাজানোর আয়োজন। অন্তুর নানির ধারণা, মেয়ে গরিব তাই অত কিছু চোখে দেখেনি বুঝি। তাই তারা যে সামান্যটুকু দিচ্ছে, সেটাই মেয়ের কাছে অনেক কিছু। তা ছাড়া মেয়েপক্ষ তো কিছুই দিতে পারবে না। ছেলেকে একটা আংটিও দেবে কি না সন্দেহ। এভাবে একেকজনের একেক অভিমত চলতে থাকল মেয়েকে নিয়ে। অন্তুর শুনে খুব খারাপ লাগল। এতে মেয়ের তো কোনো দোষ নেই, এমনকি তার বাবারও। যা হোক, লোকসমাগম খুব বেশি ছিল না, তাই দুটি মাইক্রো আর একটি প্রাইভেট কার নিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক অজপাড়াগাঁয়ে ছুটে চলল। তাই রাস্তাও ছিল অনেক খানাখন্দ। গাড়ির যাত্রীরা একবার এদিকে ঝাঁকুনি খায় তো আরেকবার ওদিকে। তাতেও তো আর মেয়ের কোনো দোষ নেই। না তাতেও তাদের সহ্য হলো না। সকলে ছি ছি করতে লাগল। গাড়ির মধ্যে অন্তুর আম্মু আর খালারা চেঁচামেচি করতে লাগল, এই কোন অজপাড়াগাঁয়ে এলাম গো বাপু। রাস্তা যখন এমন, মেয়ের এলাকা আর কেমন হবে! নানির কথাÑ এই মেয়ে নিয়ে যাব আর জীবনে আসব না বাপু। দুপুর হতে হতে অন্তুরা সেখানে পৌঁছাল। মেয়েপক্ষ তাদের সাধ্যমতো সুন্দর করে বিয়েবাড়ি সাজিয়েছে। ছেলেদের বসার জায়গা বাইরে করা হয়েছে, আর মেয়েদের ছোট একটা ঘরে। সেখানে মেঝেতে কাপড় পেতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে মেয়ের বান্ধবীরা মেয়েকে নিয়ে এল ঘরে। অন্তুর নানিদের প্রথা আছে, ছেলেপক্ষকে বউ সাজাতে হবে। তবে ছেলেপক্ষ অনুমতি দিলে মেয়েপক্ষ সাজাতে পারবে। আরেকটা প্রথা তাদের চালু আছে, তা হলো সাজানোর আগে চুলে এক ফোঁটা তেল দিতে হবে। মেয়ের ছিল লম্বা কালো চুল। অন্তুর মাঝবয়সী বড় খালামণি এক ফোঁটা তেল ঢালতে গিয়ে হাতের কাঁপাকাঁপিতে আধা বোতল তেল ঢেলে দিল। মেয়ের বান্ধবীরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। মেয়ে হয়তো ভাবতে লাগল, এবার তার বিয়ের সাজ গেছে কিন্তু তার কিছু বলার ছিল না। অন্তুর খালা তাড়াতাড়ি কাগজ দিয়ে তেল ওঠানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। মৌ আপু মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। এদিকে গরমে ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে অন্তুর নানি ভীষণ রেগে চেঁচিয়ে উঠল, হাতের তালপাতার পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে বললেনÑ যা হয়েছে ভালো হয়েছে, এবার তাড়াতাড়ি সাজাও…। রাস্তার যে অবস্থা, তাতে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। বান্ধবীরা অনেক চেষ্টা করছে চুল ফুলানোর। কিন্তু চুল কি আর ফোলে! সে তো তেলে বসে গেছে। যা হোক, অনেক কষ্টে চুলের শেপ ঠিক করা হলো। সাজানোর আধঘণ্টা না যেতেই চেঁচামেচি শুরু। আর কত দেরি? যা করেছ অনেক করেছ, আর সাজানোর দরকার নেই। বউ চুপ করে নিচের দিকে মুখ করে বসে থাকল। দু-একজন বান্ধবী একটু প্রতিবাদ করে বলল, বিয়ের সাজ একটু দেরি হবেই। এ কথা শুনে অন্তুর নানিরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, কী, এত বড় কথা, যখন ছেলে নিয়ে চলে যাব তখন বুঝবে, কত ধানে কত চাল। সব শুনে মেয়ের মা হাসিমুখে পানের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। এদিকে মেয়েপক্ষের ছোট বাচ্চারা বউসাজ দেখার জন্য ঘরে ভিড় করল। গরমের মধ্যে অন্তুর নানির ভীষণ রাগ হলো। বললেন, এক্ষুনি বের করো, ওরা বসবে না আমরা বসব। কোনো ভালো ব্যবস্থা করতে পারোনি। এটা শুনে বউ চমকে তাকাল। সব শুনে বউয়ের মা হাসিমুখে পানের থালা নানির দিকে এগিয়ে দিল। অন্তুর নানি একটা পান মুখে দিতে দিতে বললেন, এবার বাপু তাড়াতাড়ি খাওয়ার ব্যবস্থা করো। তারপর বিদায় দাও। যে দেরি করছ, তাতে মনে হচ্ছে বউ রেখে যেতে হবে বুঝি! বউয়ের মা নির্বাক তাকিয়ে রইলেন। ছোট্ট অন্তু চুপচাপ নানির পাশে বসে এসব কর্মকান্ড দেখছে আর ভয়ে কাতর হচ্ছে। আমাদের বাঙালি সমাজে মেয়েপক্ষদের কত ছোট হতে হয়। বাইরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্তুর নানি বয়স্ক, তাই উনার জন্য ভেতরেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। এবার ঘটল আরেক কাহিনি। অন্তুর মা একটা রোস্ট মুখে দিতে দিতে বললেন, ছি! বিয়ের আয়োজন তো এক করেছে খাওয়াদাওয়া তো একেবারেই বাদ। তাই শুনে বউয়ের বাবা একেবারে থ হয়ে গেলেন। অন্তুর আম্মুর সঙ্গে সব খালা সুরে সুর মেলাতে লাগলেন। ছি ছি করতে করতে ঘরে ঢুকলেন।
এবার আবার চেঁচামেচি শুরু হলো, হয়েছে গো বাপু মহারানিকে সাজানো? এবার বিদায় দাও। যাওয়ার সময় বউয়ের বাবা ছেলেকে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন, তা দেখে অন্তুর নানিদের মনটা একটু ভালো হলো। গাড়ির মধ্যে চলল বিয়েবাড়ির সমালোচনা। অন্তুর মনটা ভীষণ রকম খারাপ হলো। সব দেখে অন্তুর মনে হলো, তারা বুঝি বিয়ে খেয়ে আসছে, নাকি একটা মস্ত ঝগড়ার মীমাংসা করে বাড়ি ফিরছে। মেয়ের বাড়ির অবস্থা দেখেশুনেই তো বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে আজ এই নিষ্ঠুর আচরণ কেন? অন্তুর খুব ইচ্ছে হলো তার নানিকে প্রশ্নগুলো করতে। কিন্তু না, তা আর পারল না সে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here