বাংলা খবর ডেস্ক,ঢাকা:
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন সুদান ও বাংলাদেশে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে পিবিআইয়ের এসপি মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন এক নারী পুলিশ পরিদর্শক। গতকাল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ আবেদন করেন তিনি। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে নথি পর্যালোচনার পর আদেশ দেন বলে জানান বাদীপক্ষের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, আদালত পিবিআইয়ের এসপি মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে নারী পুলিশ পরিদর্শকের করা ধর্ষণ মামলাটি উত্তরা পূর্ব থানার ওসিকে এফআইআর হিসাবে গ্রহণ করে প্রয়েজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে আমাদের কূটনৈতিক রিপোর্টার জানিয়েছেন, বাংলাদেশের একজন শান্তিরক্ষীর বিরুদ্ধে আরেকজন শান্তিরক্ষীর অভিযোগকে নজিরবিহীন হিসেবে দেখছেন ঢাকা এবং নিউ ইয়র্কের কূটনীতিকরা। তারা বলছেন, সাধারণত বিভিন্ন দেশে কর্মরত শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া যায়। যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসাবে তদন্ত হয়। হোস্ট কান্ট্রিতে তার বিচার নিশ্চিত করা হয়। এগুলো নিয়মিতভাবে জাতিসংঘ ফলোআপও করে।
কিন্তু ২০১৯ এবং ’২০ সালে দু’দফা ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও সহকর্মীর বিরুদ্ধে সেই সময়ে কোনো অভিযোগ ওই বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা দায়ের করেছেন এমন কোনো রেকর্ড নেই বলে নিশ্চিত করেছে নিউ ইয়র্কস্থ বাংলাদেশ মিশন।
জাতিসংঘের রেকর্ড বলছে, ১৯৯২ সালে প্রথম কম্বোডিয়ায় শান্তিরক্ষীর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের যৌন হয়নারির অভিযোগ আসে। এরপর বসনিয়া ও হারজেগোভিনিয়া, হাইতি, কঙ্গো এবং পূর্ব তিমোরেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়। শান্তিরক্ষী মিশনের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের অভিযোগের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। যা ঠেকাতে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ সদর দপ্তর। তারা নানামুখি প্রতিরোধ তৎপরতা শুরু করে। ২০০৬ সালে ৩৫৭টি যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির অভিযোগ রেকর্ডভুক্ত হয়। যার মধ্যে ২৫২ জনের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনুসন্ধান করা হয়।
ওদিকে ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তার দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি মোক্তার হোসেন বাংলাদেশ পুলিশের পুলিশ সুপার জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের কন্টিনজেন্ট এর কমান্ডার হিসেবে ২০১৯ সালের মে মাসে সুদানে নিযুক্ত হন। বাদিনী সুদানে উক্ত মিশনের পূর্ববর্তী সদস্য হিসেবে কর্মরত থাকায় মিশন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় আসামি বিভিন্ন অজুহাতে বাদিনীর সঙ্গে সহযোগিতা নেয়ার নাম করে যোগাযোগ করতেন। বাদিনী সরল বিশ্বাসে নিজের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সার্বিক দাপ্তরিক সহযোগিতা প্রদান করতেন। আসামি বাদিনীকে তার জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। বাদিনী লজিস্টিক অফিসার হিসেবে আসামিকে একটি বাসার ব্যবস্থা করে দেন। একপর্যায়ে আসামি নিজে রান্না করে খেতে পারেন না, তার খাওয়া-দাওয়া কষ্ট হয় এবং রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন এমন কথা বাদিনীকে জানান। তিনি বাদিনীর বাসায় খাবার খেতে চেয়ে অনুরোধ করেন।
বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের একজন মানুষ তদুপরি নিজের একজন বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে আসামিকে বাদিনীর বাসায় খাওয়াতে রাজি হন। এরপর থেকে আসামি বাদিনীর বাসায় খাওয়া-দাওয়া করতেন। এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই আসামি বাদিনীকে তার বিভিন্ন ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করেন। স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক কলহ এবং বনিবনা না হওয়া ইত্যাদি বিষয় শেয়ার করতে থাকেন। বাদিনীর সঙ্গে প্রয়োজনাতিরিক্ত কথপোকথন করতে উদ্যত হন। বাদিনী আসামিকে বারবার বুঝাতে চাইতেন বাদিনী আসামির কাছ থেকে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা আশা করেন না। এবং বাদিনী আসামিকে বিভিন্ন ইঙ্গিতে এও বুঝাতে চান যে তার স্বামী বাসায় আসা যাওয়া, খাওয়া ও অপ্রয়োজনীয় কথা পছন্দ করেন না। তবুও আসামি বাদিনীর সঙ্গে অপ্রয়োজনে কথাবার্তা চালাতে থাকেন।
২০১৯ সালের ২০শে ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ সেরে আসামি বাদিনীর বাসা হতে বেরিয়ে গেলে বাদিনী বিশ্রাম নিতে থাকেন। এর এক ঘণ্টা পর আসামি বাড়ির দরজা নক করলে ঘুমের ঘোরে বাদিনী দরজা খুললে আসামি বাসায় প্রবেশ করে সোফায় বসেন। এরপর বাদিনীকে বাদিনীর ব্যবহৃত গাড়ির চাবিটি দিতে বলেন। এ সময় বাদিনী ইউনিফর্মের প্যান্টের পকেট হতে চাবি বের করতে গেলে আসামি বাদিনীকে পিছন দিক থেকে জাপটে ধরেন। বাদিনী আত্মরক্ষার্থে ঘরময় ছুটে বেড়ানোর একপর্যায়ে আলমারির আড়ালে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে আসামি বাদিনীকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে আলমারির পার্শ্ববর্তী টেবিলের উপর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন এবং এই ঘটনা কাউকে না জানাতে বাদিনীকে ভয়ভীতি দেখান। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর বাদিনীর সঙ্গে দেখা করে আসামি পূর্বের কৃত ঘটনার জন্য বাদিনীর নিকট ক্ষমা চান এবং পরক্ষণেই আসামি পূর্বের মতো আচরণ করে ওইদিন ১টার সময় বাদিনীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। এই ঘটনার পর থেকে বাদিনী আসামিকে আর তার বাসায় ঢুকতে দিতেন না। কিন্তু আসামি সবসময় বাদিনীর বাসার দরজায় উচ্চ শব্দে ধাক্কাধাক্কি করতেন। টেলিফোন করে বিভিন্ন অজুহাতে দেখা করতে চাইতেন। বাদিনী আসামিকে ফোনে বারবার বলেন, আপনি আমার দরজা ধাক্কাচ্ছেন কেন, আমি আপনাকে আমার বাসায় ঢুকতে দেবো না। আপনি আমার বাসায় ঢুকে আমাকে জোর করে ধর্ষণ করেছেন। আমি আপনাকে নিষেধ করার পরও আপনি আমার বাসায় জোর করে ঢুকতে চাচ্ছেন কেন। দয়া করে আপনি চলে যান। মান সম্মানের ভয়ে পাশের বাসার কাউকে কিছু জানাতে পারেন নাই। আসামি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বাদিনীকে অসহায় ও ভীত-সন্ত্রস্ত করেন। ডিপার্টমেন্টাল হয়রানির ভয়ভীতি দেখিয়ে বাদিনীর বাসায় প্রবেশ করে বাহিনীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন।
এজাহারে বলা হয়, বিগত ২০২০ সালের ১লা মার্চ আসামি বাদিনীকে ফুসলিয়ে, ভুল বুঝিয়ে প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে মুখে কলেমা পড়ে মৌখিকভাবে বিবাহ করেন এবং বাদিনীকে আশ্বস্ত করেন বাংলাদেশে ফিরে এই মৌখিক বিবাহ রেজিস্ট্রি কাবিন করবেন বলে ফের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন।
পরবর্তীতে বাদিনীকে নিয়ে দেশে ছুটিতে আসেন। দেশে এসে ২০২০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি আনুমানিক রাত ১১টা হতে ১০ই ফেব্রুয়ারি আনুমানিক ভোর ৫টা পর্যন্ত উত্তরার হোটেল ডি মেরিডিয়ান লিমিটেড এর ২০৬ নম্বর রুমে বাদিনীকে বিবাহের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করেন। এরপর ২৬শে জুন থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত সুদানের খার্তুমে হোটেল শমিলোতে বাদিনীকে আসামি বিবাহের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণ করেন। একইভাবে ১০ই নভেম্বর হতে ১৩ই নভেম্বর পর্যন্ত হোটেল ডি মেরিমিডিয়ানের ৩০৬ নম্বর রুমে বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেন।
আসামির দেয়া পূর্ব আশ্বাসের ভিত্তিতে বাদিনী আসামিকে মৌখিক নিকাহ রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করার তাগিদ দিলে আসামি বাদিনীর সঙ্গে অশোভন আচরণ শুরু করেন। একপর্যায়ে কৌশলে বাদিনীকে এড়িয়ে যেতে থাকেন। এহেন পরিস্থিতিতে বাদিনী চলতি বছরের ১২ই আগস্ট আসামির ঢাকাস্থ রাজারবাগের বাসায় উপস্থিত হন। আসামিকে তার প্রদত্ত আশ্বাস অনুযায়ী বিবাহের কাবিননামা সম্পন্ন করার জন্য তাগিদ দিলে আসামি অস্বীকৃতি জানায় এবং আসামি, আসামির স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যগণ উত্তেজিত হয়ে বাঁদিনীকে মারধর করেন এবং আসামি বাদিনীকে বিভিন্ন রকম হুমকি-ধমকি দিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাদিনী অসহায় হয়ে পড়েন এবং বুঝতে পারেন আসামি বাদিনীর সরলতার সুযোগ নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় প্রথমে বাদিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করেন এবং পরবর্তীতে বাদিনীর সঙ্গে প্রতারণা করে বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন। এ বিষয়ে বাদিনী গত ১০ই আগস্ট উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা করতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে মামলা গ্রহণ না করে বিজ্ঞ আদালতে মামলা করার জন্য বলেন।