বাংলা খবর ডেস্ক,ঢাকা:
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলায় আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছর কারাদণ্ড বহাল রেখে রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাজী সেলিম বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন বলে বৃহস্পতিবার তার আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা জানিয়েছেন।
বুধবার বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক স্বাক্ষরিত এ রায় প্রকাশ করা হয়। এ মামলায় হাজী সেলিম বর্তমানে জামিনে আছেন।
রায় প্রকাশের পর হাজী সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, হাইকোর্টের রায়ে হাজী মোহাম্মদ সেলিম সাহেবকে এক মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। ওনার সঙ্গে কথা বলেছি। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে এক মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পন করে সুপিম কোর্টের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করব।
হাজী সেলিমের ১০ বছর কারাদণ্ড বহাল রেখে প্রকাশিত রায়ে বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক পদধারী হলেও তাকে বিচারের আওতায় এনে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে হবে।
আদালত বলেন, আমরা সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, এখন পর্যন্ত দুদক এ রকম হাজারো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু এর জন্য চেষ্টা থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ওপর নির্ভর করে আছে।
‘দুর্ভাগ্যবশত’ মিডিয়া কাভারেজের ওপর নির্ভর করছে দুদক : হাইকোর্ট
ওদিকে দুর্নীতি বা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাহস-সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘সংস্থাটি নিজেদের সাহস-সক্ষমতা না বাড়িয়ে এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ায় মিডিয়া কাভারেজের ওপর নির্ভর করছে। ’
‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজি সেলিমকে বিচারিক আদালতের ১০ বছর সাজার রায় বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে এ পর্যবেক্ষণ এসেছে।
‘কমিশনের কাজ এবং নিষ্ক্রিয়তা’ নিয়ে রায়ের পর্যেবেক্ষণে বলা হয়েছে,‘আমরা সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করেছি যে, আপাত দৃষ্টিতে হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ থাকার পরও দুদক তাদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ-সম্পত্তির বিষয়ে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সক্ষমতা-সাহস না দেখিয়ে দুর্ভাগ্যবশত মিডিয়া কাভারেজের ওপর নির্ভর করছে।
একটি কার্যরকর-সক্রিয় কমিশন দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে রায়ে বলা হয়েছে, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্নীতি নির্মূল করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তার জন্য আমরা সক্রিয় এবং কার্যাকর একটি কমিশন দেখতে চাই, যে কমিশন সাংবিধানিক পদধারী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারী যে-ই হোক না কেন, খুঁজে বের করে দুর্নীতির মূল উৎপাটন করবে। ’
শারীরিক শাস্তিতে দুর্নীতি নিরাময় সম্ভব না
রায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিকারও বাতলে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘দুর্নীতি একটি মানসিক রোগ। শারীরিক শাস্তিতে এর নিরাময় সম্ভব না। এর জন্য সুবিধাপ্রাপ্ত, সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি তাদের তালিকা করে কমিশন, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের প্রধানদের দিয়ে তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করতে হবে। আমরা জানি যে এটি একটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ একজন সৎ ব্যক্তি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির শিকার হতে পারেন। কিন্তু আমাদেরকে সভ্য ও দুর্নীতিমুক্ত স্বাধীন জাতি হতে হবে। ’
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক, দার্শনিক হেনরি সিডউইককে উদ্বৃত করে রায়ে বলা হয়েছে, “রাজনৈতিক সভ্যতা একটি জাতির অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়। আর কোনো কিছু এর নির্ধারক হতে পারে না। হেনরি সিডউইকের এ বক্তব্যের আলোকে আমাদের রাজনৈতিক সভ্যতার স্তর কোন জায়গায়, তা মূল্যায়ন করতে হবে। এ ছাড়া ‘দুর্নীতির স্তর’ দিয়েও আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্রের অবস্থান নির্ধারণ করা হচ্ছে। ”
রায়ে আরো বলা হয়েছে, ‘কারো কারো জন্য আমাদের মান-মর্যামদাহানি ঘটছে। আমরা লজ্জিত হচ্ছি। কারণ মানসিকভাবে দুর্নীতিকে বৈধতা দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দেশের প্রত্যেকটি খাতকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তারা শক্তিশালী এবং সংগঠিত চক্র। যে কারণে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দুর্নীতিগ্রস্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। ’
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় দুটি ধারায় বিচারিক আদালতে ১০ বছর ও তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল হাজি সেলিমের। এর মধ্যে একটি ধারায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে আরেকটি ধারায় তিন বছরের সাজা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
গত বছর ৯ মার্চ বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিলেন। ৬৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি আজ বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে।