সুপ্রিম কোর্টে জালিয়াতি বন্ধে ১৩ সুপারিশ

0
234

বহিরাগতদের দৌরাত্ম্যে সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে জাল আদেশ তৈরি বন্ধে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটি’। একটি জামিন জালিয়াতির ঘটনার অনুসন্ধানে নেমে কমিটির পক্ষ থেকে এসব সুপারিশ করা হয়েছে।

জালিয়াতির মামলাটি আদালতের নজরে আনা সুপ্রিম কোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী জিন্নাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আদালত এসব সুপারিশ দেখেছেন। সুপারিশগুলো যেন বাস্তবায়ন হয়, সেজন্য আদালত নির্দেশও দিয়েছেন।’

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের তত্ত্বাবধানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটিতে হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. আব্দুছ সালাম এবং সহকারী রেজিস্ট্রার (প্রশাসন) সোহাগ রঞ্জন পাল।

যা আছে ১৩ দফা সুপারিশে

১. মামলার (মোশন মামলা) নম্বর পড়ার সময় ফাইলিং শাখার এন্ট্রি রেজিস্ট্রারে শুধু নিয়োজিত আইনজীবীর নাম উল্লেখ করা হয়। এতে আইনজীবীর সদস্য নম্বর উল্লেখ থাকলে তাকে শনাক্তকরণ সম্ভব হবে। তাই রেজিস্ট্রার খাতায় আইনজীবীর সদস্য নম্বর উল্লেখ করতে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি হতে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে।

২. মোশন দরখাস্ত এফিডেবিট করার পর এন্ট্রি রেজিস্ট্রারে শুধু ডেপোনেন্টের নাম উল্লেখ করা হয়। ফলে পরবর্তীতে ডেপোনেন্টকে শনাক্তকরণ করা সম্ভব হয় না। তাই এফিডেবিটের সময় ডেপোনেন্টের ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি সংরক্ষণ করার নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে।

৩. মামলার ফাইলিং ও এফিডেবিট শাখায় আইনজীবী ও আইনজীবীদের সহকারী শনাক্তকরণের জন্য ডাটাবেস তৈরি করে সফটওয়্যার ইনস্টল করা যেতে পারে।

৪. একজন বেঞ্চ অফিসার/সহকারী বেঞ্চ অফিসার জামিনাদেশ টাইপ করে সেটি পিডিএফ ফাইলে কনভার্ট করে দেবেন। এতে এই কপিটি পরবর্তীতে শাখা হতে আদেশের সঠিকতা যাচাই কাজে ব্যবহার হতে পারে।

৫. আদালত থেকে মোশন দরখাস্ত ফৌজদারি মিস শাখায় পাঠানোর বিষয়ে একটি ‘পিয়ন বুক’ ব্যবহার সঙ্গত হবে। তবে একাধিক পিয়ন বুক থাকলেও সেখানে যেন দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাই এন্ট্রি দেন, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রি থেকে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে।

৬. জামিনাদেশ ইস্যু কপি প্রস্তুত ও সই করার সময় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের সই মিলিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি থেকে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে।

৭. কোর্ট থেকে শাখায় মামলার (মোশন) নথিসহ অন্যান্য নথি গ্রহণকারীর একটি প্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সংরক্ষণ করতে হবে।

৮. সব রেজিস্টার খাতা যথাযথভাবে প্রত্যয়ন করে সংরক্ষণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের দফতরের রেজিস্টার খাতাগুলো বেঞ্চ অফিসারকে দিয়ে এবং শাখার রেজিস্টার খাতাগুলো সংশ্লিষ্ট সহকারী রেজিস্ট্রার দিয়ে প্রত্যয়নের জন্য সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি থেকে নির্দেশনা জারি করা যেতে পারে।

৯. শাখায় শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে শাখার সুপারিনটেনডেন্টদের মধ্যে নথিতে সই করা, নথি গ্রহণ করা, টাইপ করা ও নথি যথাযথভাবে র‌্যাকে রাখাসহ বিভিন্ন বিষয় তদারকির জন্য সহকারী রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে আলাদা কর্মবণ্টন প্রস্তুত করতে হবে।

১০. সিভিল রুল শাখার আদলে ফৌজদারি মিস কেস শাখাটি বিভাগ অনুযায়ী পৃথক করে অধিক সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী পদায়ন করা যেতে পারে এবং প্রতিটি বিভাগের রেকর্ড সংরক্ষণের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

১১. ফাইল শাখার এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে নথি গেলে রেজিস্ট্রার খাতায় এন্ট্রি দেওয়া হয়, কিন্তু গ্রহণকারীর সই নেওয়া বা রিভিস দেখানো হয় না। ফলে নথি খোঁজার ক্ষেত্রে গ্রহণকারী অস্বীকার করলে নথি গ্রহণের বিষয়ে তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা যায় না। কাজেই ফাইল গ্রহণকারীর সই রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

১২. জালিয়াতির ঘটনায় ফৌজদারি মিস (বিবিধ) শাখার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ও দায়ী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

১৩. জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত ও দায়ী আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী, সুবিধা পাওয়া আসামিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা যেতে পারে।

মো. আলী জিন্নাহ বলেন, ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অনুসন্ধান কমিটির ১৩ দফা সুপারিশের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হবে। কেননা, এসব সুপারিশ অনুসারে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফলেই একটি পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে ১৩ দফা সুপারিশ সংক্রান্ত ফাইলটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতরে রয়েছে। আদালতের নির্দেশে তিনি এখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

প্রসঙ্গত, জাল নথির মাধ্যমে জামিন পাওয়ার ঘটনা হাইকোর্টের নির্দেশে অনুসন্ধান করে দেখা হয়। ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বহিরাহতদের মাধ্যমে জাল আদেশ তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাইকোর্টের ফৌজদারি বিবিধ শাখার প্রায় ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম উঠে আসে। তবে মামলার আইনজীবী ও তদবিরকারীকে এখনও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here