‘এই দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের, স্বাধীনতা বিরোধীদের নয়’- প্রধানমন্ত্রী

0
1498

বাংলা খবর ডেস্ক: দেশবিরোধী শক্তি কোনদিন যেন এদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের, স্বাধীনতা বিরোধীদের নয়। তিনি বলেন, লাখো শহীদের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা যেন কোনদিন ব্যর্থ হতে না পারে এজন্য দেশবাসীসহ সকলকে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি এবং যুদ্ধাপরাধীদের দেশ নয়, এই দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের, আমরা সেভাবেই দেশটাকে গড়ে তুলতে চাই। তিনি আরও বলেন, যারা স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করতে চায়, তারা যেন কোনদিন ক্ষমতায় না আসতে পারে, আগামীতে এ দেশ হবে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের। রাজাকার, আলবদর, আল শামস আর খুনীরা যেন আর কখনো ক্ষমতায় না আসতে পারে, সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ফার্মগেটস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের মিলনায়তনে ৪৮তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এবং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম, কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য এসএম কামাল হোসেন এবং ঢাকা উত্তর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএ রহমতউল্লাহ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশীদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বক্তৃতা করেন। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম সভাটি পরিচালনা করেন এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদের জন্য সম্পদ করা নয়, জনগণ যাতে সম্পদশালী হয়, উন্নত হয়, বাংলাদেশে একটা মানুষও যাতে গৃহহারা না থাকে, কেউ যেন না খেয়ে কষ্ট না পায় এবং একটা মানুষও বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না- আমরা সেটাই করতে চাই। তাই তাঁর সরকারের লক্ষ্য তৃণমূল পর্যায় থেকে উন্নয়ন করা, আমরা গ্রাম পর্যায় থেকে উন্নয়নের কাজটা শুরু করেছি। কোন ঘর অন্ধকারে থাকবে না দেশের প্রতি ঘরকে তাঁর সরকার আলোকিত করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই লক্ষ্য এবং নীতি নিয়েই তিনি দেশ পরিচালনা করছেন বলেই দেশে আজ এই উন্নতিটা হচ্ছে, আর ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো দেশের কোন উন্নতি করতে বা দেশের মানুষকে কিছু দিতে পারে নাই, তারা নিজেরা মুষ্টিমেয় কিছু লোকই সম্পদশালী হয়েছে আর বাকীর খাতায় শূন্য বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দেশে জিয়াউর রহমানের আমল থেকেই খেলাপি ঋণের কালচার চলে আসছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জিয়ার আমল থেকেই এই দুর্নীতির শুরু যা ধারবাহিকভাবে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া যখনই যে সরকারে এসেছে, তাই করেছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি করা আর নিজেদের সম্পদ গড়া, নিজেদের বিলাস-ব্যসন, ভোগ- বিলাস- এই নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিল। দেশের মানুষের দিকে তারা ফিরে তাকায়নি। দীর্ঘ বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে নানা সময়ের ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তাকে গ্রেফতারের কথা তুলে ধরেন।
সরকার প্রধান বলেন, তখন অত্যাচার নির্যাতন করেছে বিএনপি সরকার। আর গ্রেফতার করা হলো আমাকে। কারা এই কাজ করেছে, তা আমি জানি। বিএনপি-জামায়াত জোটের সময়ের বিবরণ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তারা বাংলা ভাই সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের দেশে পরিণত করেছে। গ্রেনেড হামলা তো আছেই। এইভাবে অত্যাচার করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করেছে তারা, ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। আবারও মসজিদের ইমাম, শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদকের বিষয়ে কোনো ছাড় দেবেন না। এসব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করবেন। যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী তারা দেশ ও মানবতার শত্রু। কোনো ছেলে-মেয়ে যেন জঙ্গিবাদে না জড়ায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছেলে-মেয়েরা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে সেদিকে অভিভাবকদের নজর রাখতে হবে।
২০০৮ সালের নির্বাচনেও যেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসতে পারে, তার জন্যও ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার গঠন করলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলব। যে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করলেন, তারা ভিক্ষা করবে বা রিকশা চালাবে, এটা অপমানজনক। তিনি দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, তাদের সন্তানেরা পড়ালেখার সুযোগ পাবে না, সেটা হতে পারে না। তাই আমরা ক্ষমতায় এসে তাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করলাম। আমরা চেষ্টা করছি, সবার মধ্যে ইতিহাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে উজ্জীবিত হচ্ছে, তারা সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে। অথচ ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তারা জানে না (ষড়যন্ত্রকারীরা), ইতিহাসকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে সরকার গঠন করেছি। এরপর ২০১৩ সালে তারা এক দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি করে। সেই অবস্থা আমরা সামাল দিয়েছি। ২০১৪ সালে আবার নির্বাচন হয়, মানুষের ভোটে ক্ষমতায় আসি। কিন্তু তারা (বিএনপি-জামাত) ২০১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস করে।
বিএনপি-জামায়াত সাড়ে ৩ হাজার মানুষ পুড়িয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাজার হাজার গাড়ি, বাস, ট্রাক, লঞ্চ আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। সরকারি অফিসে আগুন দিয়েছে। কেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো-এটাই তাদের অন্তর্জ্বালা। তারা তো ক্ষমতায় থেকে ভোগ-বিলাস করেছে, মানি লন্ডারিং করে ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, তারা এতিম খানার টাকা পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছে। সবকিছু ধরা পড়েছে। এতে আমাদের কোনও হাত নেই। কিন্তু আদালত তাদের সাজা দিলে তারা মানে না। তারা কিছুই মানে না। তারা ক্ষমতায় থেকে মানুষকে হত্যা করেছে, এখনও তাই করতে চায়। দেশের কোনও উন্নয়ন তারা চোখেই দেখে না, অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের খন্ড চিত্র তুলে ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার সময় অনেকে ব্যঙ্গ করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ। মানুষ সেবা পাচ্ছে, মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে, আমরা এখন স্যাটেলাইটও উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করার পরে, এটির ১৫ বছর মেয়াদ থাকবে। কাজেই ৫ বছরের মধ্যেই আবার শুরু করতে হবে। এভাবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ করবো তারপরে ৩ করবো এভাবে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য নেয়া রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আজকে মেট্রো রেল নির্মাণ হচ্ছে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলে টানেল, আমরা ফ্লাইওভার করে দিচ্ছি, হাইওয়েগুলো চারলেন বিশিষ্ট করে দিচ্ছি, ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে গেছে। ঢাকা-সিলেট শীঘ্রই শুরু হবে, ঢাকা ময়মনসিংহ থেকে একেবারে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু পর্যন্ত- এভাবে আমরা ব্যাপকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে দিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী এ দিন পদ্মা সেতু নিয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগের পেছনে নোবেল জয়ী ড. মো. ইউনুসের জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, একটা মাত্র লোক বিশ্বের অনেক নামকরা প্রাইজ পেয়েও তাঁর মন ভরে নাই একটা ক্ষুদ্র ব্যাংকের এমডি পদের লোভ সামলাতে পারেন নাই। সেই এমডি পদের লোভে আমেরিকায় লবিং করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সেই টাকা বন্ধ করে দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই আমাদের বলে গেছেন আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, আর আমি জাতির পিতার কন্যা তাই সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ছিলাম। তারা (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক) দুর্নীতির অভিযোগ আনতে চেয়েছিল বহু চেষ্টা করেছে। শেষমেষ এজেন্সি হায়ার করেছে আমার বিরুদ্ধে বোন ও ছেলের বিরুদ্ধে, দুর্নীতি পায় কি না। পায়নি। আবার সেই এমডি সাহেবও আমেরিকাকে দিয়ে তদন্ত করিয়েছেন কিন্তÍ তদন্ত কিছু না পেয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা বন্ধ করিয়ে আমাদের ওপর দোষারোপ করার চেষ্টা করেছেন- কানাডার ফেডারেল কোর্টে মামলা হয়েছিল তারা বলে দিয়েছে- সমস্ত অভিযোগ ভুয়া।
শেখ হাসিনা বলেন, একটা জিনিস মনে রাখবেন বিএনপি ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ৫ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি যে করে নাই, সেটা আমাদের মুখের কথা নয়, আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত। তিনি বলেন, অর্থসম্পদ মানুষের চিরদিন থাকে না। সম্পদ কেউ কবরেও নিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু সম্পদের জন্য মারমারি কাটাকাটি করে। মানুষ মরে গেলে ঐ সম্পদ পড়ে থাকে। কিন্তÍু মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়া একজন রাজনীতিবিদের জন্য কর্তব্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও তাই করে গেছেন আর তাঁর কন্যা হিসেবে এটা তিনি তাঁর দায়িত্ব মনে করেন বলেও উল্লেখ করেন।
পারিবারিকভাবেই ভিন্ন শিক্ষায় বড় হওয়াতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা তথাকথিত শাসক শ্রেণীর মতো হয়নি বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তাঁর বাবা বলতেন, এদেশের জনগণ যারা একবেলা ভাত পায় না তাদেরতো অতো জৌলুস দেখানোর কিছু নেই। তাদের জন্য বরং কাজ করতে হবে। রাজনীতিবিদ হিসেবে এই জনগণের জন্য কতটুকু করে যেতে পারলেন প্রাপ্তির ভান্ডারে সেইটুকুই জমা, বলেন তিনি। তাঁর পিতা পরপার থেকে দেখছেন এবং তিনি সকল কাজে তাঁর সঙ্গে আছেন বলেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে দেশের এতো উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে। আজকে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হয়ে বিশ্বে সন্মান পাচ্ছি, পিতার কাছে এটুকু বলতে পারলেও মনে শান্তি পেতেন, বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন বঙ্গবন্ধু তনয়া। তিনি বলেন, আমরা দুই বোন যখন কথা বলি তখন এসব উন্নয়নের কথা বলি, মনে হয় আমার আব্বা যেন শুনতে পাচ্ছেন, জানি না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here