গণপিটুনির আড়ালে পরিকল্পিত সন্ত্রাস

0
75

সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রুম্মান হোসেনকে মা পারুল বেগম বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে ফুচকার দোকান দেখে ছেলে খেতে চায়। মা নিষেধ করলে শিশু কান্না শুরু করে দেয়। দুই মিনিটের মধ্যেই ওই ফুচকাওয়ালাসহ সাত-আটজনের একটি দল এগিয়ে আসে। মা-ছেলেকে ঘিরে ধরে জানতে চায় ছেলেধরা কি না। জটলা দেখে পারুল ও তার ছেলে ঘাবড়ে যায় এবং ছেলে আম্মু আম্মু বলে পারুলকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ওই সাত-আটজনের দলটি পারুলকে জেরা করতে থাকে। এ সময় জোহরের নামাজ পড়তে বের হওয়া কয়েকজন মুসল্লিকে দেখে পারুল মুরুব্বি মুরুব্বি বলে ডাকতে থাকেন। পরে তারা গিয়ে মা-ছেলের সঙ্গে কথা বললে বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটে।

সোমবার দুপুর পৌনে ২টায় মগবাজার ওয়্যারলেসের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলে পারুল এই প্রতিবেদককে জানান, ছেলেধরা গুজবে স্কুলগামী বাচ্চা এবং তাদের মায়েরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, গত ১৫ দিন ধরে স্কুলে অভিভাবকদের সবার মুখে এক কথা। প্রথমত সত্যিই ছেলেধরা রয়েছে কি না আর দ্বিতীয় আতঙ্ক হলো যখন-তখন যে কেউ এই রোষানলে পড়তে পারেন। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম।

সাভার প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত রবিবার গভীর রাতে সাভারের ধামরাইয়ে রোয়াইল ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর এলাকায় সৌদিফেরত ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদকে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। কৃষ্ণনগর এলাকার ফজল মিয়ার ছেলে আজাদ দীর্ঘদিন সৌদি আরবে থেকে বাংলাদেশে ফিরে মাটির ব্যবসা করতেন।

ধামরাই থানা পুলিশের ভাষ্য, আজাদের সঙ্গে একই এলাকার মুদি দোকানি সাইফুল ইসলামের স্ত্রী রোজিনার পরকীয়া ছিল। দোকান পাহারা দিতে সাইফুল দোকানেই রাত্রিযাপন করতেন। এর সুযোগ নিয়ে রোজিনার সঙ্গে আজাদের পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিষয়টি জানতে পেরে রোজিনার স্বামী সাইফুল স্ত্রীকে দিয়ে কৌশলে গত রবিবার রাতে আজাদকে বাসায় ডেকে আনেন। পরে পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ডাকাত’ বলে স্থানীয়দের নিয়ে পিটুনি দিলে ঘটনাস্থলেই আজাদের মৃত্যু হয়। স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে পুলিশ মুদি দোকানি সাইফুল, তার স্ত্রী রোজিনা ও তাদের সহযোগীসহ ছয়জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।

ধামরাই থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, ‘পরকীয়ার জের ধরে পরিকল্পিতভাবে মাটি ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হত্যাকারীরা নিজেদের বাঁচাতে নানা উপায় খুঁজতে থাকে ও ভুল তথ্য দেয়। পরে সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদে মূল ঘটনা বেরিয়ে আসে।’

গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বাকপ্রতিবন্ধী সিরাজ নিজের মেয়েকে দেখতে গিয়ে ছেলেধরা অপরাধে গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, সিরাজ তার সাবেক স্ত্রী সামছুন্নাহার ও তার স্বামীর রোষানলের শিকার হয়েছেন। সামছুন্নাহার ও তার বর্তমান স্বামী কৌশল করে জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন।

গত রবিবার নওগাঁর মান্দায় মাছ ধরতে গিয়ে পুকুরমালিকের বাগ্বিতন্ডার একপর্যায়ে ছয় জেলেকে ছেলেধরা বানিয়ে গণপিটুনি দেওয়া হয়। ওইদিন কুসুম্বা ইউনিয়নের বুড়িদহ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় রণজিত কুমার তার পুকুরে মাছ ধরার জন্য ওই ছয় জেলেকে নিয়ে আসেন। কথা ছিল পুকুরমালিক নেবেন মাছের ৭০ শতাংশ এবং জেলেরা পাবেন ৩০ শতাংশ। মাছ ধরার সময় বনিবনা না হওয়ায় রণজিত হঠাৎ ছেলেধরা বলে চিৎকার করেন এবং আশপাশ থেকে লোকজন এসে ছয় জেলেকে মারতে থাকে।

রবিবার রাতে বন্ধুর অনুরোধে তার প্রেমিকার কাছে মোবাইল ফোন পৌঁছে দিতে গিয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের পীরের বাজার এলাকায় ২৪ বছরের যুবক বসন্ত শব্দকর বন্ধুর প্রেমিকার পরিবারের রোষানলে পড়ে গণপিটুনির শিকার হন। বসন্তের বাড়ি কমলগঞ্জ উপজেলার নরেন্দ্রপুর এলাকায়। তাকে কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় কুলাউড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন সূত্রে জানা গেছে, বসন্তের বন্ধু একই এলাকার বাসিন্দা হাবিব মিয়ার সঙ্গে পীরের বাজার এলাকার এক তরুণীর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। ওই তরুণী হাবিবের কাছে একটি মোবাইল চান। পরিবারের সবাই এই সম্পর্ক টের পেয়েই বসন্তের সঙ্গে এ ঘটনা ঘটায়। পরিবারের ওই সদস্যরা ভেবেছিলেন বসন্তই হাবিব। কুলাউড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, বসন্ত ছেলেধরা নয়।

তিনি বলেন, ছেলেধরা গুজবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে লোকজনকে বলা হয়েছে। কোনো মানুষের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে তা দ্রুত পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিংও করা হয়েছে।

এদিকে বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর ঘটনায় সারা দেশ স্তম্ভিত। ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে আতঙ্ক দেখা দেয়। রেনুর কয়েকজন আত্মীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, রেনুর ঘটনাও স্বাভাবিক নয়। তার সাবেক স্বামী ও তার আত্মীয়স্বজন মিলে এই ছেলেধরা গুজবের সুযোগ নিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক জিয়া রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এই গুজব এবং গণপিটুনি যদি এখনই প্রতিরোধ করা না যায় তবে এটি সন্ত্রাসে রূপ নিতে পারে। যে কেউ তার ছোটখাটো শত্রুতার এবং প্রতিহিংসার বদলা নিতে এই হাতিয়ার ব্যবহার করবে। তিনি বলেন, এর পুরো দায় পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আসবে। তবে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও কিছু দায় আছে। এটাকে বলা যায় ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের আগের অবস্থার মতো। অর্থাৎ যে সমাজে বিচার ব্যবস্থার বিকাশ হয়নি সেসব সমাজে এমন ঘটনা ঘটে। এসব সমাজের মানুষের ধারণা, আমরা তো অনেক বলেকয়েও বিচার পাচ্ছি না। তাই আইন নিজের হাতে তুলে নিই। মধ্যযুগের বিচার ব্যবস্থায় এটি চালু হয়। এ ধরনের গণপিটুনির সবগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।

অধ্যাপক জিয়া বলেন, উন্নত দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেটির যথাযথভাবে তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করা হতো। অথচ এখানে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার পর এটা নিয়ে আর আলোচনা হয় না, এটা যে করা যায় না, তা বলা হয় না। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টার মধ্যে ক্রসফায়ারের সাইকোলজিক্যাল যে ভিত্তি সেটাই লুকায়িত। সাধারণ মানুষের মাইন্ডসেটে এই জিনিস আছে বলেই ক্রসফায়ার জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনো সভ্য সমাজে বিচার ব্যবস্থার যে ব্যবহার, সেটার মধ্যেই পৌঁছতে পারিনি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে মানুষ যখন নিরাপদ বোধ করে না এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে তখনই এ ধরনের মানসিকতা তৈরি হয়। এটা ‘মব’-এর একটা চরিত্র। এই মবরা রিফাত হত্যা বা অভিজিৎ রায়কে প্রকাশ্যে কোপানোর ঘটনায় কিন্তু নিজেদের যুক্ত করবে না। কিন্তু ছেলেধরা, সড়ক দুর্ঘটনা, চুরি, ছিনতাই এসব গুজবে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। তারা মনে করে, এটা পুলিশের কাছে গেলে বিচারের মুখ দেখবে না। তাই নিজেরাই বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আর এর সুযোগ কেউ গ্রহণ করতে পারে।

মানবাধিকার নেতা অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, আইনের শাসন নেই বলেই গুজব এখন আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। নিরীহ মানুষ এই গুজবের শিকার হবে। সরকার এবং তার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি এটা কঠোর হাতে দমন না করতে পারে তাহলে রেনুর মতো অনেকেই এই ঘটনার বলি হবে। সন্ত্রাসী এবং বাজে মানুষরা এই হাতিয়ার কাজে লাগাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here