চ্যালেঞ্জে বিএনপি

0
264

এম. লুব্দক

নির্বাচনী বছরে আবারো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পরেছে বিএনপি। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাদন্ড দলটির স্বাভাবিক কর্মকান্ডকে উলটপালট করে দিয়েছে। নির্বাচনী দাবি আদায় কিংবা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার বদলে দলটির এখন মূল এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছে দলীয় প্রধানের কারামুক্তি। খালেদা জিয়ার সহসা জামিন প্রাপ্তির যে ‘আশা’ দলের অভ্যন্তরে জাগ্রত হয়েছিল, তাতে চিড় ধরেছে। নির্বাচনের আগে তার মুক্তি মিলবে কিনা সেই সংশয়ও রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ সূক্ষ পর্যালোচনায় নিয়ে দলটিকে এখন তাই পথ চলতে হচ্ছে সতর্কভাবে।
একদশ সংসদ নির্বাচনের ৯/১০ মাস বাকি থাকায় দলের নেত্রীর কারামুক্তিকে ঘিরে কঠোর কোন আন্দোলনেও নামতে পারছে না বিএনপি। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে দেড় মাসেরও বেশি সময় পার করেছে তারা। দলটির নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, সংঘর্ষে জড়াতে শত উষ্কানি রয়েছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও তাদের পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় তারা ফাঁদে পা না দিয়ে সংযত থেকেই নানামুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবেন।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরান ঢাকার জেলখানায় রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শে শীর্ষ নেতারা বিশেষভাবে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দল পরিচালনায় সামনে থেকে ভূমিকা রাখছেন। খালেদা জিয়ার কারাবন্দির সাথে সাথে বিএনপির ঐক্যে ফাটল ধরতে পারে, এমন প্রপাগান্ডা ছিল বিভিন্ন মহলে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত সে ধরনের ন্যূনতম কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। বরং সাংগঠনিক কার্যক্রমে সব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে বিএনপিতে এখন আরো বেশি ঐক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া এখন তারা অন্য কিছুই ভাবছে না। সব ধরনের প্রতিকূলতা পেরিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে মাঠে থাকার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। চেয়ারপারসনের মুক্তি ত্বরান্বিত করতে এক্ষেত্রে মাঠের কর্মসূচি ও আইনী লড়াই ছাড়াও নানা তৎপরতা চালানো হচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে থাকলেও দল পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন বদলের সিনিয়র নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে তার। ইতোমধ্যে তিনি তিনটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথমত : দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকা, দ্বিতীয়ত : কঠিন এ সময়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং তৃতীয়ত : নির্বাচনের মাঠ প্রস্তুত করা।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চাইতে বিএনপি এখন ঐক্যবদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নেতারা রাজপথে সক্রিয়ও। সব প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে বিএনপি আবারো ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, দেশের এই চরম সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা বদ্ধপরিকর। যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে আমরা প্রস্তুত। আন্দোলন সফলে আমরা রাজপথেই থাকব।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, সরকার যতই কঠোর হোক না কেন হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না বিএনপি। শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে তারা। নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী জনমত তৈরি করাই তাদের মূল লক্ষ্য। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত এ কৌশলেই এগোতে চায় দলের হাইকমান্ড।
এ মুহুর্তে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে শক্তি ক্ষয় করতে নারাজ বিএনপি। দলটির নেতাদের মতে, চেয়ারপারসনের কারাবাসের পর আক্রমণাত্মক কর্মসূচি দিলে সরকারও হার্ডলাইনে যাবে। সে কারণে তারা হরতালসহ সহিংস কোনো কর্মসূচির দিকে যাচ্ছে না। দলের নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নিতে রাজপথে নেমে আসছেন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে ক্রমশ উপস্থিতি বাড়ছে। এ অবস্থায় সহিংস কোনো কর্মসূচি দেয়া হলে অতীতের মতো আবারও সুযোগ নেবে ক্ষমতাসীন দল। এতে দেশে-বিদেশে দলের ভাবমূর্তিও সংকটে পরবে। একই সঙ্গে সারা দেশে নেতাকর্মীদের ওপর মামলা ও ব্যাপক ধরপাকড়ে আবারও ব্যাকফুটে চলে যাবে দল।
ফের ক্ষমতায় আসতে নানা ভাবনা
খালেদা জিয়ার কারাবন্দির পর আগামী নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি নিয়েও নানা সমীকরণ চলছে। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে সরকারের মধ্যে নানা বিকল্প নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। এ ভাবনায় কখনো স্থান পাচ্ছে আগাম নির্বাচন, কখনো খালেদা জিয়াবিহীন নির্বাচন, আবারো কখনো বিএনপিকে ‘শক্তিশালী’ বিরোধী দল বানিয়ে ক্ষমতার পথ আরো প্রশস্ত করার মতো বিষয়গুলো। এই মূহুর্তে বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে থাকলেও নির্বাচনের চার-পাচ মাস আগে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে এমন তথ্যও রয়েছে সরকারের কাছে। সেই তথ্যের উপর ভর করে ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া শুরু হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা এক্ষেত্রে সরকারের কাছে একটি বড় অস্ত্র। যার প্রয়োগ চলছে বছরজুড়ে। নির্বাচনের মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী মাসগুলোতে এই প্রক্রিয়া আরো জোড়ালো হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করলেও বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়। দলটির হাইকমান্ড মনে করছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তারা এবার মাঠে নামতে পারলে অতীতের মতো বিফল হতে হবে না। সমঝোতার মধ্য দিয়ে সরকার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। বিএনপি নেতাদের মতে, যদি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়, তাহলে বিএনপিকে আটকানো মুশকিল হবে।খালেদা জিয়ার কারাবন্দির পর নির্বাচনকেন্দ্রিক দলীয় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চিন্তা থেকেই কঠোর কোন আন্দোলনে যায়নি বিএনপি।
সরকার নির্বাচনের মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে বিএনপিকে আর কোন স্পেস দেয়ার পক্ষপাতী নয়। বিএনপি প্রধানের কারাবন্দির পর দলটির কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি এবং তা নিয়ে মানুষের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর সরকার আরো নড়েচড়ে বসেছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে ঘরোয়া রাজনীতিতেই আবদ্ধ করে রাখতে চায় তারা।
সরকারি দলের মধ্যে ধারণা রয়েছে, বিএনপিকে কর্মসূচি পালনে সহযোগিতা করা হলে পর্যায়ক্রমে আন্দোলন আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে। এক পর্যায়ে তা সহিংস রূপ নিতে পারে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সেজন্য বিএনপির চলমান আন্দোলনকে নিস্প্রভ রাখার চেষ্টা চলছে।
সরকারি দলের নেতাদের ভাবনা অনুযায়ী- খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরো কয়েকটি মামলার কারণে জেল থেকে তার শিগগিরই বের হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যদি দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি বিলম্ব হওয়াকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতাকর্মীরা যদি রাস্তায় নেমে আসে তাহলে তাদের আইনিভাবে দমন করা সহজ হবে। আর নৈরাজ্য না করে ঘরোয়া রাজনীতিতে আবদ্ধ থাকলে দলটি প্রচারের মুখ দেখতে পারবে না। এতে করে জনগণের সমর্থন লাভ করাও তাদের পক্ষে সহজ হবে না।
নির্বাচনের বছরে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের পর জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর প্রতিক্রিয়াও পর্যবেক্ষণে রেখেছে সরকার। বাংলাদেশ সফরে এসে ট্রাম্প প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা লিসা কার্টিস সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়েও পাননি। লিসা কার্টিস আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাব তুলে ধরে গেছেন। তিনি একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
আগামী ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে উন্নয়ন সহযোীদের চাপ কিভাবে মোকাবেলা করা হবে, তা নিয়ে সরকারের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। একটি পক্ষ মনে করছে, নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য না হলে সরকারকে আবারো বিতর্কের মুথে পরতে হবে, দায়ভার নিতে হবে। অপরপক্ষ মনে করছে, ২০১৪ সালের ১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আদলে না হলেও মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করতে হবে। তবে দুই পক্ষই আরেকবার ক্ষমতায় আসাকে নিজেদের রাজনীতির জন্য নিরাপদ ভাবছে।
বিভিন্ন সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে কোন কৌশল অবলম্বন করা হবে, মাঠ পর্যায়ে তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় একদিনে। ৩০০ আসনে সমান শক্তি প্রয়োগ করে নির্বাচনে বিজয়ী করা সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এ কারনেই ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার নিজেদের চাপ কমিয়ে ফেলেছিল। আগামীতে বিএনপি নির্বাচনে এলে এই কৌশল কাজে লাগাবে না। সেক্ষেত্রে টার্গেট ভিত্তিক আসনগুলোতে বিজয় নিশ্চিত করতে এখনি কাজ শুরু হয়েছে। বিএনপির সম্ভাব্য আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের দুর্বল করতে নতুন নতুন মামলা দায়ের এবং সক্রিয় কর্মীদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। রাজনৈতিক মামলাগুলোতে নতুন করে জড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আগামী নির্বাচনের ফলাফলকে নিজেদের অনুকূলে আনতে বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত আসনগুলোতে বিশেষ পন্থায় কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ২০টির মতো জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোই এর মূল কারণ বলে আলোচনা রয়েছে।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আগামী নির্বাচন নিয়ে একটি লিখিত বার্তা দেয়া হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে কারারুদ্ধ করার বিষয়টি তারা সেখানে তুলে ধরেছে। উন্নয়ন সহযোগীরা এ বিষয়ে নজড়দারি অব্যাহত রেখেছে। সরকার ও বিরোধী দল উভয় শিরিরের সাথে তাদের যোগাযোগ চলছে। তবে সরকার নিজেদের মতো করে সকল পরিস্থিতি উত্তরনের চিন্তাভাবনা করছে।

লেখক:kmoindu@gmail.com

##

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here