ঢাকায় অ্যাপস ও মাদক সম্রাজ্ঞি : ব্যাংকে মিলল কয়েক কোটি টাকা

0
261

হাসান মাহমুদ
রাজধানীতে মাদক ভয়াবহতার একদিনের চিত্র হচ্ছে ২১ হাজার ৭শ ২৫ পিস ইয়াবা, ১ কেজি ১৪০ গ্রাম গাাঁজা, ৭২৭ পুরিয়া হেরোইন উদ্ধার। ২৩ মার্চ সকাল ৬টা থেকে গতকাল ২৪ মার্চ সকাল ৬টা পর্যন্ত নগরির বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব মাদকসহ ৬১ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তারচেয়েও ভয়াবহ ঘটনা হচ্ছে, প্রযুক্তির মাধ্যমে অভিজাত এলাকায় মাদকে ছয়লাব করে দিচ্ছে যে অপরাধী চক্র তারা অনেকেই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বছরের পর বছর অ্যাপস ব্যবহার করে ধানমন্ডিতে মাদক রাজত্ব গড়ে তুলে এক মাদক স¤্রাজ্ঞি। তার নাম আসমা আক্তার ডালিয়া। তার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গেছে প্রচুর ইয়াবা। ঢাকার এলিফেন্ট রোডের ব্র্যাক ব্যাংকের একটি শাখায় ডালিয়ার ৬টি হিসাব নম্বর এবং তার স্বামীর একটি ব্যাংক হিসাব নম্বর থেকে পাওয়া গেছে মাদক বিক্রির ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। তার নিজস্ব হিসাব নম্বর থেকে লেনদেন হয়েছে মাদক বিক্রির কোটি কোটি টাকা। এসব আলামত এখন তদন্তকারী দলের হাতে রয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, বড় ডিলার এবং গডফাদারদের আধুনিক অ্যাপস ব্যবহারের ঘটনা। অপরাধিরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে নির্বিঘেœ মাদক পাচার কাজে অ্যাপস-এর সাহায্য নিচ্ছে বলে জানা যায়। অ্যাপস দিয়ে বার্তা প্রেরণ, ইয়াবার ছবি প্রেরণ, চালান সরবরাহকারীর কোড নম্বর দেয়া-নেয়ার কাজ হচ্ছে অ্যাপস ব্যবহার করে। মাদক পাচারের কাজে নিজেদের মধ্যে ফোনালাপ ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় তারা অ্যাপস ব্যবহার করে। তদন্তে প্রকাশ, উঁচু তলার মাদক স¤্রাজ্ঞি হিসেবে পরিচিত ডালিয়া তার মাদক সা¤্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন প্রযুক্তিকে খাটিয়ে। সর্বাধুনিক অ্যাপস ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে মাদক পাচারের ‘স্মার্ট নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। প্রযুক্তি নির্ভর বড় মাপের যে ক’জন মাদক ডিলার রয়েছে তাদের মধ্যে ডালিয়ার অবস্থান অনেক শক্তিশালি বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানান।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক ও তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন ভুঁইয়া জানান, দীর্ঘ ৩ বছরেও তাকে হাতেনাতে ধরা সম্ভব হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদে ডালিয়া জানায়, তার মোবাইল সেটে এমন কিছু প্রোগ্রামিং রয়েছে, অজ্ঞাত নম্বর থেকে তাকে ফোন দিলে ডালিয়া তার নাম-ঠিকানা ও অবস্থান শনাক্ত করতে পারে। একাধিক সোর্সের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে ডালিয়াকে বিপুল মাদকসহ গত ৯ জুলাই ভোরে অ্যালিফেন্ট রোডের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ঢাকা নিউমার্কেট থানায় মামলা (নং ০৫) দায়ের করা হয়েছে। এখন মামলার চার্জশিট দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।
যেভাবে অভিযান
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ঢাকার নিউ মার্কেট থানা এলাকায় একাধিক সোর্সের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েই ‘মেডাম ডালিয়া’কে গ্রেফতারের প্রস্তুতি চলছিল। গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে ১৭৩, এলিফেন্ট রোডের সেল সিদ্দিক প্লাজার ৯ম তলার ৮/বি বাসাটি ‘রেকি’ করা হয় কয়েকবার। নারকোটিক্স বিভাগের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমার নেতৃত্বে ভোর হবার অপেক্ষায় সবাই। ৩ জন পরিদর্শক, নারী সেপাই, নিউ মার্কেট থানার পুলিশ অবস্থান নেয় আসামির বাসার অদূরে এলিফেন্ট রোড বাটার সিগন্যালের পাশে। অভিযানের আগেই তথ্য ছিল বহুল আলোচিত মাদক স¤্রাজ্ঞি ডালিয়া বাসায় অবস্থান করছেন। অভিযানিক দলের সহকারী পরিচালক (দক্ষিণ) শামসুল আলম জানান, ওই ফ্ল্যাটে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার দুর্ধর্ষ মাদক ডিলার হিসেবে পরিচিত ‘নাসির’ অবস্থান করতে পারে। ডালিয়ার ঘুম ভাঙ্গার আগেই অভিযানিক দলের ১৪ জনের একটি দল ভবনটির ৯ম তলায় পৌঁছে যায়। দরজা খুলতেই ফ্ল্যাটে আসমা আহমেদ ডালিয়া এবং তার স্বামী রবিউল ইসলামকে দেখতে পান তারা। জিজ্ঞাসাবাদে ডালিয়া জানায়, কাঠের আলমিরার ভেতর নীল রঙের জিপারে কিছু পলি প্যাকেট রয়েছে। তা উদ্ধার করে পাওয়া যায় ৩২ হাজার ইয়াবা। মাদক বিক্রির ১ লাখ ৫০ হাজার নগদ টাকা। জিজ্ঞাসাবাদে ডালিয়া আরো জানায়, তার মা মনোয়ারা বেগমের পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাটে ইয়াবার একটি চালান মজুদ আছে। আসামিদের সঙ্গে নিয়ে ৫২/৩ পশ্চিম রাজাবাজারের ৩য় তলায় ফ্ল্যাট নম্বর ২/বি তে অভিযান চালিয়ে মনোয়ারা বেগমকে আটক করার পর তার দেখানো মতে ওয়ারড্রবের ভেতর থেকে ১২ হাজার পিস ইয়াবা এবং মাদক বিক্রির ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, ডালিয়ার পুরো পরিবার মাদক কারবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে জড়িত।
অ্যাপস ব্যবহার
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মাদকের বড় ডিলার হিসেবে পরিচিত নাসির উদ্দিন (নাসির) ডালিয়ার অন্যতম মাদক জোগানদাতা। তার কোন চালানই ৫০ হাজার পিস ইয়াবার নিচে হয় না। পুরো কার্যক্রমটি তারা পরিচালনা করতো অ্যাপস ব্যবহারের মাধ্যমে। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, নাসির চট্রগ্রাম থেকে ঢাকার গাউসিয়া মার্কেটের একটি পরিবহনের কাউন্টারের ঠিকানায় নিজেই একটি মোবাইল নম্বর থেকে চালান বুকিং দেয়। পরদিন সকালের ফ্লাইটে ঢাকায় এসে ওই চালানে থাকা আরেকটি মোবাইল নম্বর দেখিয়ে চালানটি সংগ্রহ করে নিত। তারপর ডালিয়া তার পাজেরো গাড়ীতে বসে অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য নিয়ে একজনের কোড নম্বর পাঠিয়ে দিত নাসিরকে। সেই কোড নম্বরধারীই চালানটি সংগ্রহ করতো। একই পদ্ধতিতে ডালিয়া তার অন্য চালানগুলো অভিজাত এলাকায় ছড়িয়ে দিত।
ব্যাংক হিসাব জব্দ
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট-এর নির্দেশে গত ১৭ সেপ্টেম্বর দেশের সকল ব্যাংকের প্রতি এক নির্দেশে আসমা আহমেদ ডালিয়ার হিসাব স্থগিত রাখতে বলা হয়। তার আরো ব্যাংক হিসাব আছে কিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর সহযোগিতায় ডালিয়ার ৬টি ব্যাংক হিসাব থেকে আটক করা হয় মাদক বিক্রির ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। ব্র্যাক ব্যাংকের এ্যালিফেন্ট রোডের একটি শাখায় ডালিয়ার ৫টি হিসাব (১৫৩৫২০২৯২৯৬৫০০১, ১৫৩৫৩০২৯৬৫৬০০১, ১৫৩৫৩০২৯২৯৬৫০০৩, ১৫৩৫৩০২৯২৯৬৫৬০০৪, ১৫৩৫১০১৬৩৩২৪৯০০০১), তার স্বামী রবিউল ইসলামের একটি হিসাব ১৫৩৫১০১৭২৬৪৩৭০০১ এবং একই এলাকার স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ডালিয়ার আরেকটি হিসাব (০১৭৩৩১০০৩৬৭) থেকে এই টাকা উদ্ধার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া আরো বিপুল পরিমাণ টাকা এসব হিসাব থেকে লেনদেন করা হয়েছে বলে তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারী দল।
##

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here