শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, টেকনোলজি মানুষের মহা উপকারে আসতে পারে, আবার টেকনোলজি মানুষের সর্বনাশও করে দিতে পারে। দুটিই তার রাস্তা। কোন্ দিকে নিয়ে যাবে- এটা মানুষের ইচ্ছা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) নিয়ে দুনিয়াকে সতর্ক করেছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার ব্যাঙ্গালুরুর বিখ্যাত আইটি সেন্টার ইনফোসিস-এ সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রফেসর ড. ইউনূস এ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন। ৪২টি দেশ থেকে ১২০০ ডেলিগেট এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স যে শুরু হয়েছে, শুরু হওয়ার প্রথম কাজটা ছিল যে মানুষকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে সে দায়িত্ব নেবে।
মানুষের কাজ সে করে দেবে, আরো ভালোভাবে করে দেবে, সস্তায় করে দেবে। কাজেই যারা মুনাফা করতে চায়, তাদের জন্য এটা একটা লোভনীয় জিনিস। কস্ট অব প্রডাকশন কমে যাচ্ছে, মুনাফা বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই তারা উৎসাহী হয়ে এটা করছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যাদেরকে আমরা নিয়ে এলাম কাজ থেকে, চাকরি থেকে ওরা যাবে কোথায়? ওদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। এবং সেটা দুই একজনের বিষয় নয়। সারা বিশ্বজুড়ে। এটা শুধু বাংলাদেশ বলে কথা নয়, যুক্তরাষ্ট্র বলে কথা নয়। সারা বিশ্বজুড়ে ওদের সরিয়ে দেয়া হবে, দরকার নেই। ব্যাংক চালাতে চাও ওটা মেশিনে করবে, টেলিভিশন চালাতে চাও মেশিনে করবে, সাংবাদিকতা করতে চাও মেশিনে করবে। মেশিন সাংবাদিক সাংবাদিকতায় পুরস্কার পেয়েছে। মেশিন গল্প লেখক সাহিত্যে পুরস্কার পাচ্ছে। সে কিন্তু যন্ত্র।

কাজেই সরিয়ে দিচ্ছে সবকিছু থেকে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তো মানুষ যাবে কোথায়? সমাধান হিসেবে যারা এটার পেছনে আছে তারা বলছেন- না, না। সরকারের পক্ষ থেকে একটা বেসিক ইনকাম সবাইকে দিয়ে দেয়া হবে। অর্থাৎ মাসিক একটা ভাতা দিয়ে দেয়া হবে। আমি বলেছি, মানুষের কপালে কী এই ছিল সর্বশেষ। যে আমাদের ভিক্ষুক হতে হবে। ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হবে। আমাদের আর করার কিছু নেই। আমি বলেছি, সে ভবিষ্যৎ আমি দেখতে চাই না। সেদিকে আমি যেতে চাই না। তোমরা আমাকে আশ্বস্ত করো যে, এটা হবে না, কীভাবে হবে না সেটা আমাকে বলো। তা না হলে আমি বলবো তুমি লাইন ক্রস করছো। যেটা মানুষের মঙ্গলের জন্য করা হয়েছিল, সেটা সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছো। এই মঙ্গল আর সর্বনাশের মাঝখানে যে দাড়ি সে রেখাটা অতিক্রম করছো তুমি। আমরা কিছুতেই তোমাকে সে রেখা অতিক্রম করতে দেবো না। মানুষ হিসেবে এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা। এটা এক নাম্বার।

দুই নাম্বার হলো যে, এদের ক্ষমতা বাড়বে। মেশিনের ক্ষমতা। মেশিন কাজের মধ্যে থেকে থেকে নিজের বুদ্ধি বাড়িয়ে নিচ্ছে। কাউকে শিখিয়ে দিতে হচ্ছে না। সে নিজেই শিখছে। সে যখন একবার শিখে যাচ্ছে কিছুই ভুলছে না। মানুষ তো ভুলে যায়। কাজেই তার বুদ্ধিমত্তা ক্রমে ক্রমে মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে। মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটা সীমারেখা আছে। কিন্তু ওর তো সীমা নেই। তো যন্ত্রের ক্ষমতা মানুষের দ্বিগুণ হলো, তিনগুণ হলো, ১৪ গুণ হলো। তার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কী হবে সে প্রশ্ন আমি তুলতে চাই। সে আমার দিকে কীভাবে তাকাবে? সে দেখবে বোকা কতগুলো মানুষ ঘুরে বেড়ায়। কাজ নেই, কর্ম নেই। এগুলো দুনিয়াতে রেখে কী লাভ হবে।
ঝামেলা এগুলো। তো তার বুদ্ধি বেশি। ঝামেলা থেকে অতিক্রম করতে হলে কী করতে হবে। সে জানে কী করতে হবে। এবং সুন্দরভাবে করে ফেলবে। সে এমনও করতে পারে আমাদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিতে পারে। যাতে আমরা নিজেরা নিজেদের শেষ করে দেই। করতে পারে এগুলো। কারণ তার বুদ্ধি বেশি। সে বলবে আমি তো করিনি, তোমরাই করছো। তো আমরা কী এই শতাব্দীর মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। এই সমস্ত ঘটনা কিন্তু ঘটছে এই শতাব্দীতেই। ১০ বছর পর অন্য কথা শুনতে হবে। মেশিন তোমাকে বলে দেবে কী করতে হবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, উদ্যোক্তা হতে হবে। সেটাই আমাদের ন্যাচারাল জিনিস। পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের শিখিয়েছে আমাদের চাকরি করতে হবে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ইন্টারপ্রিটেশন। মানুষ চাকরি করার জন্য সৃষ্টি হয়নি। আমরা কোনোদিন কারও কাছে চাকরি করিনি। আমরা যখন গুহাবাসী ছিলাম তখন কোনো চাকরি করতাম না। সেটাই আমাদের ইতিহাস। আমরা শিকার করেছি, ফার্মার হয়েছি। ফার্মার কোনোদিন চাকরি করেনি। এখন বলছে চাকরি করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর ড. ইউনূস বলেন, থ্রি জিরো সেটাই আমাদের অর্জন করতে হবে। বর্তমান কাঠামোই দারিদ্র্য তৈরি করে। দারিদ্র্য কমছে, কিন্তু দারিদ্র্যের মূল কারণ দূর হয়নি। কাজেই আমাদের কাঠামো বদলাতে হবে। মুনাফা করতে চাও করো তার সঙ্গে সোশ্যাল বিজনেসও করতে হবে। আমরা চাকরি প্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা। শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণের পথে হাঁটলেই কেবল মুক্তি মিলতে পারে।
সূত্র : মানব জমিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here