শোকাবহ ১৫ই আগস্ট আজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকী। জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এইদিনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে নির্মমভাবে সপরিবারে শাহাদতবরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও নাতি সুকান্ত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে থমকে দাঁড়ায় সদ্য স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে আজ সারা দেশে পালিত হবে শোক দিবস। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে স্মরণ করা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।  দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। জাতীয় শোক দিবসকে সামনে রেখে আগস্টের প্রথম প্রহর থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন কর্মসূচি পালন করছে। সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে দিবসটির বিভিন্ন কর্মসূচি। দিবসটিকে ইতিমধ্যেই সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

সরকারি কর্মসূচির মধ্যে ১৫ই আগস্ট সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসহ বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পুুষ্পার্ঘ্য অর্পণ এবং সশস্ত্র বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এ ছাড়া ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার বনানী কবরস্থানে জাতির পিতার পরিবারের শাহাদাত বরণকারী সদস্য ও অন্যান্য শহীদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ এবং দোয়া করবেন।
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এ ছাড়া সেখানে ফাতেহা পাঠ, সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান এবং মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি সমাধিস্থলে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থা জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্ব স্ব কর্মসূচি পালন করবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া। ছড়িয়ে পড়ে হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ওই ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে।

ওই  বছরের ১৪ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২রা অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এএফএম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ই নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ই মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ১৯শে জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা বাধার কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ই নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ই ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এবিএম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।

২০০১ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি বিভক্ত রায় প্রদানের ফলে মামলাটি ডেথ রেফারেন্সে ও আপিল শুনানি দ্বিতীয় বেঞ্চের তৃতীয় বিচারকের কাছে স্থানান্তরের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় এর শুনানি উচ্চ আদালতের আরেকটি বেঞ্চে শুরু হয়। একই বছরের ৩০শে এপ্রিল তৃতীয় বিচারক মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২৫ দিন শুনানির পর অভিযুক্ত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩শে আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩শে সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

২০০৯ সালের ১২ই নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯শে নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯শে নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮শে জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। এদিকে পলাতক ছয় আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের দাবি উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিবছর। এমন দাবি সামনে রেখে এবারও জাতীয় শোক দিবস পালিত হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here