বিজয়ের এই দিনটি

0
110

বাংলা খবর ডেস্ক: মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধ আর আক্রমণে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি হানাদাররা ডিসেম্বরের শুরু থেকেই পালানোর পথ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আর তাই ৩ ডিসেম্বর ভারতের কয়েকটি এলাকায় বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিয়ে জাতিসংঘের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় তারা। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় পৃথিবীর বুকে অভিনব এ প্রকাশ্য আত্মসমর্পণ। সেই দিনটি নিয়ে লিখেছেন পরাগ মাঝি

যেভাবে শুরু হয় পালানো

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনী। সম্মিলিত বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে ঢাকায় পাকিস্তানিদের পতন ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার। সেই সময়টিতে বাংলাদেশে অবস্থান করা পাকিস্তানি বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার লেখা বই থেকে জানা যায়– পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, কীভাবে যুদ্ধ থামানো যায় সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছিলেন ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা।

৫ ডিসেম্বর কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলে একটি পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নের আত্মসমর্পণের পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে পারলেন, তাদের সৈন্যদের মনোবল ভেঙে গেছে। যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে ৭ ডিসেম্বর। সেদিন রাতে প্রাণভয়ে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ পলায়নের বর্ণনা পাওয়া গেছে, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ‘অনন্তের অনুভব : বিজয় মুহূর্ত’ শিরোনামে একটি লেখা থেকে। ৭ ডিসেম্বর তিনি খুলনায় অবস্থান করছিলেন। সেদিন সন্ধ্যার পরপরই ব্রজলাল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালানো পাকিস্তানি বহরের প্রথম গাড়িটি দেখতে পান।

হাসান আজিজুল হক লিখেছেন, ‘যশোর থেকে এটা যে পাকিস্তানি বাহিনীর পিছু হটে আসা, সেটা তখনই বোঝার উপায় ছিল না।’ তার ভাষায়– নয় মাস ধরে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো আচরণ করা পাকিস্তানি বাহিনীকে পালানোর সময় কোণঠাসা ইঁদুরের মতো লাগছিল। ভ্যান, ট্যাংক ও জিপে করে সারা রাত ধরে সৈন্যরা অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে যশোর থেকে পালাচ্ছিল। পরদিন বেলা ১১টা পর্যন্ত এ গাড়িবহর যেতে দেখেছেন লেখক। এরপরই তিনি দেখেন, একদল সৈন্য কোনো গাড়ি না পেয়ে হেঁটে হেঁটে বহরের পিছু পিছু যাচ্ছে।

হেঁটে যাওয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘এদের আর গাড়ি-টারি জোটেনি। যদি যশোর থেকে আসে তাহলে অন্তত ৩০ মাইল তাদের হাঁটতে হয়েছে লোহার নাল পরানো ভারী বুট পায়ে, কাঁধে রাইফেল চাপিয়ে। এখন লোহার টুপি কাঁধে ঝোলানো, জুতার ফিতে খোলা, খাকি মোজা নেতিয়ে পড়েছে, শার্টের বোতাম খোলা, বেল্ট আলগা হয়ে ঝুলছে, চোখের ভেতর শকুন উড়ছে। লালসা আর লোভের আগুন নিভে গেছে। দেহের কোনো অন্ধকার গর্তে ঢzকে প্রাণ কাঁপছে ঠকঠক করে।’

শুধু যশোর কিংবা কুমিল্লা নয়, সারা দেশেই পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। আর ঢাকা অভিমুখে অব্যাহত থাকে অগ্রসরমাণ মিত্রবাহিনী।

নিয়াজির দম্ভোক্তি

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি সর্বাধিনায়ক জেনারেল এ কে নিয়াজি ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল পরিদর্শনে যান। কিন্তু সামরিক হাসপাতালের একদল নার্স এসে জেনারেল নিয়াজিকে তাদের নিরাপত্তাজনিত শঙ্কার কথা জানান। কারণ তারা সবাই মুক্তিবাহিনীর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। নিয়াজি নার্সদের আশ্বস্ত করলেন, বড় ধরনের বিদেশি সাহায্য আসছে এবং চিন্তার কোনো কারণ নেই।

জেনারেল নিয়াজি ভাবছিলেন তাদের জন্য বিদেশি সহায়তা আসবে। বিদেশি সহায়তা বলতে চীন কিংবা আমেরিকার সাহায্য। তিনি নার্সদের জানালেন, কোনোভাবেই তাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়তে দেওয়া হবে না। বললেন, ‘যদি সাহায্য নাও আসে তাহলে তোমরা মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়ার আগে আমরাই তোমাদের হত্যা করব।’

সেখান থেকে ফিরে আসার সময় তেজগাঁও বিমানবন্দরের সামনে থামেন জেনারেল নিয়াজি। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল– ভারতীয় বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য আপনার কি যথেষ্ট শক্তি আছে?

জবাবে নিয়াজি বলেন, ‘আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে ঢাকার পতন হবে। আমার বুকের ওপর দিয়ে তাদের ট্যাংক চালাতে হবে।’

এ ঘটনাটির উল্লেখ আছে তৎকালীন পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামক বইটিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সবসময় নিয়াজির পাশেই অবস্থান করতেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে দম্ভোক্তির মাত্র পাঁচ দিন পরই অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিলেন নিয়াজি।

ঢাকার বুকে মুক্তি

নার্সদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। নিয়াজির সঙ্গে তাদের দেখা হওয়ার পরদিনই অর্থাৎ ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথমবারের মতো মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর কামানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর হাউজের ওপর আক্রমণ চালায়। ওই হামলার পর প্রাণভয়ে গভর্নর পদত্যাগ করেন। ঢাকার বুকে মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগোপ্তা হামলার পাশাপাশি ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধবিমান থেকে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ফেলতে শুরু করে।

এ সময়টির বর্ণনা পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও লেখক সরদার ফজলুল করিমের লেখা ‘আমি বিজয় দেখেছি?’ শিরোনামের একটি স্মৃতিচারণা থেকে। ওই সময়টিতে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৪-১৫ ডিসেম্বর কারাগারে একটি ভবনের দোতলায় বন্দি থাকাবস্থায় তিনি এর আশপাশে থাকা ভবনগুলোর ছাদে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান নিতে দেখেন। আর দেখেন, আকাশে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় জঙ্গিবিমানের যুদ্ধ এবং ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। আকাশপথের এ যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ কারাগারের ভেতরেও এসে পড়েছিল। জেলের বাঙালি সিপাহি এবং বন্দিরা এসব ধ্বংসাবশেষের নমুনা সংগ্রহ করে লেখককে দেখাত। এমনকি ভারতীয় বাহিনীর লিফলেটও কারাগারে বসেই তিনি দেখেছিলেন। যদিও আত্মসমর্পণ নয়, বরং যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে ওই সময়টিতে আত্মরক্ষার উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেসামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলির লেখা একটি বই থেকে জানা যায়, ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেলের কাছে যান। নিয়াজি মার্কিন কনসাল জেনারেলের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। জবাবে কনসাল জেনারেল বললেন, ‘আপনারা কেন যুদ্ধ শুরু করেছিলেন? ইউএস আপনাদের সাহায্য করতে পারবে না।’ তবে তিনি আশ্বাস দেন, নিয়াজির যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব তিনি বড়জোর ভারতীয়দের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন।’

আসন্ন পরাজয়কে সামনে রেখে সেদিন রাতেই পাকিস্তানের দোসর আলবদর বাহিনী অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে রাতের অঁাধারে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

সারেন্ডার লাঞ্চ

১৬ ডিসেম্বর। সকাল সোয়া ৯টা। বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল জেনারেল মানেকশ ফোন করেন কলকাতায় অবস্থান করা ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জেকবকে। এ ফোনালাপে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ কেমন হবে তার একটি খসড়া দলিল নিয়ে কথা বলেন। ওই দলিলটি তখন ভারত সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। এ ফোনালাপেই মানেকশকে জেকব জানান যে, একটি রেডিও মেসেজে জেনারেল নিয়াজির কাছ থেকে তিনি লাঞ্চের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। মানেকশ তাৎক্ষণিকভাবে এ আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে জেকবকে কিছু বলেননি। পরে কলকাতা থেকে হেলিকপ্টার নিয়ে যশোর বিমানবন্দরে এলে জেকবকে নিয়াজির লাঞ্চে অংশগ্রহণের জন্য সবুজ সংকেত দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ সংকেত পেয়ে কর্নেল খারাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার এয়ারফিল্ডে হেলিকপ্টার নিয়ে উড়ে আসেন জেকব। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান পাকিস্তানি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী। পরে তারা নিয়াজির দপ্তরে যান। যদিও পথের মধ্যে তাদের একদল মুক্তিবাহিনী গতিরোধ করে। জেকব মুক্তিযোদ্ধাদের বলেন, ‘যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করবেন আজই।’ তবে এ কথায় সন্তুষ্ট হওয়ার মানসিকতায় ছিল না উত্তেজিত মুক্তিযোদ্ধারা। জেকব তাদের বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সদস্যরা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য শিগগিরই ঢাকায় এসে পৌঁছবেন।

১৬ ডিসেম্বর দুপুর ১টার দিকে নিয়াজির দপ্তরে পা রাখেন জেকব। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের বেসামরিক বিষয়ের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, মেজর জেনারেল জামশেদসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তা। এছাড়াও সেখানে উপস্থিত হন আরেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিসি নাগরা। কাদের সিদ্দিকীর এক স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, নাগরার সঙ্গে তিনিও উপস্থিত ছিলেন নিয়াজির দপ্তরে। জেকব নাগরাকে বাইরে ডেকে রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে আবারও নিয়াজির কক্ষে ফিরে আসেন।

প্রস্তাবিত লাঞ্চের আগেই জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের খসড়া পড়ে শোনানো হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জেকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি নিয়াজির অফিসে ফিরে এলে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তাবলি পাঠ করে শোনান। নিয়াজির চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন স্তব্ধতা।’

পাকিস্তানি বাহিনী আশা করেছিল তাদের প্রস্তাবিত যুদ্ধ বিরতির মধ্য দিয়ে একটি সম্মানজনক বিদায় নেওয়া। আত্মসমর্পণের অনীহা ছিল তাদের। সেখানে উপস্থিত রাও ফরমান আলি তাৎক্ষণিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছিলেন, আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

লাঞ্চের বর্ণনা দিতে গিয়ে জেকব লিখেছেন, ‘মেসের যে চিরাচরিত খাবার– মুরগির রোস্ট দিয়ে মেইন কোর্স।’ জেকব আর খারা এক কোণে দাঁড়িয়ে পরাজিত পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের খোশগল্প আর খাওয়া দেখছিলেন। ভূরিভোজের ব্যাপারে তাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না।

রেসকোর্সের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ

বিকেল ৩টার দিকে নিয়াজিকে নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হন জেকব। সামনে একটি পাইলট জিপ নিয়ে নিয়াজির গাড়িতে করেই তারা এয়ারপোর্টের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। এবারও তাদের পথ আটকে দেন একদল মুক্তিযোদ্ধা। তাদের কেউ কেউ গাড়ির বনেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে নিয়াজিকে রক্ষা করেন কর্নেল খারা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বলেন, নিয়াজি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি। তাই তাদের বাধা দেওয়া উচিত হচ্ছে না।

এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এয়ারফিল্ডে ঢোকার পরও। কারণ একটি ট্রাকে করে ফিল্ডে ঢzকে পড়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আরও একটি দল। জেকব দাবি করেন, এই দলটির মধ্যে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তিনি তাকে বাঘা সিদ্দিকী নামেই চিনতেন। জেকব এ ড়্গেত্রে কাদের সিদ্দিকীকে কোনো অনাকাি•ক্ষত ঘটনা ঘটানো থেকে নিবৃত্ত করেন এবং এয়ারফিল্ড থেকে সরে যেতে বলেন।

বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে ভারতীয় আর্মি কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কয়েকটি হেলিকপ্টার নিয়ে সস্ত্রীক অবতরণ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন ভারতীয় কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশি উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন এ কে খন্দকার। পরে পুরো দলটি রওনা হয় রেসকোর্স ময়দানের দিকে। সেখানে গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরোরা ও নিয়াজি এগিয়ে যান আত্মসমর্পণ টেবিলের দিকে। অরোরার সঙ্গে করে নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের দলিল টেবিলের ওপর রাখা হয়। নিয়াজি সেটার ওপর কৌতূহলী চোখ বুলিয়ে নিয়ে সই করেন। মিত্রবাহিনীর পক্ষে সই করেন অরোরাও। এরপর নিয়াজি তার কাঁধ থেকে সেনা অধিনায়কের সম্মানসূচক ব্যাজ খুলে ফেলেন এবং তার ব্যক্তিগত ‘পয়েন্ট ৩৮’ রিভলবারটি অরোরার হাতে ন্যস্ত করেন। তার চোখে অশ্রু দেখা যাচ্ছিল। সন্ধ্যাও নেমে আসছিল। রেসকোর্স ময়দান তখন লোকে-লোকারণ্য। অবিশ্বাস্য এক আনন্দ সবার চোখেমুখে। সাধারণ মানুষরা উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কুলাকুলি হই-হুল্লোড় করছিলেন। তাদের সবার মুখেই ছিল মুক্তির হাসি। যেন সবকিছুই শুরু হলো– নতুন করে। সরদার ফজলুল করিমের লেখা থেকেই একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বিজয়ের পরদিন সকালে কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট খুলে দিয়েছিলেন। নানা কারণে দণ্ডিত শত শত আসামি কারও নির্দেশের অপেক্ষা না করেই জেলের পোশাক ছুড়ে ফেলে প্রায় বস্ত্রহীন অবস্থায় জেলের সামনে নাজিমউদ্দিন রোড দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। তবে রয়ে গিয়েছিলেন শুধু লেখক অধ্যাপক এবং তার সঙ্গে অন্য বন্দি কামরুদ্দিন আহমদ। কামরুদ্দিনের ছেলেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সরদার ফজলুল করিম ও কামরুদ্দিন জেলের গেটে গিয়ে কারারক্ষীদের বললেন, ‘আমরা এখন কী করব?’ কারারক্ষীরা বলল, এখন তো কোনো আইন নেই, হুকুম নেই। আমরা কী বলব?

বিজয়ের দিনটি একদিকে যেমন ছিল বাঁধভাঙা আনন্দের অন্যদিকে এদিনটিতেও কিছু এলাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। বিজয়ের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে কবি সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন ‘দিনটি কেটেছে বেদনায় কষ্টে’ শিরোনামে। এই স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন– কীভাবে বিজয়ের দিনেও পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ডোরা নামে এক নারী ডাক্তারের মৃত্যু ঘটেছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here