কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় পিটিয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে পূর্ব ঘোষিত সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় আন্দোলনকারীদের অন্তত ১৫ জন আহত হন। তাদের মধ্যে নুরুল হক নূরসহ চারজনের অবস্থা গুরুতর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ৯৭তম বার্ষিকীর একদিন আগে ক্যাম্পাসে এ হামলার সময় একজন শিক্ষকও লাঞ্ছিত হয়েছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর এ হামলার প্রতিবাদে আজ থেকে দেশের সকল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। একই সঙ্গে অবরোধ কর্মসূচিও পালন করবেন তারা। গতকাল সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল তাদের। কিন্তু সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগ মুহূর্তে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। হামলায় অংশ নেয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। যদিও সংগঠনটির সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেন। এদিকে হামলা চলাকালে তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ।

প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনকারীদের সূত্রে জানা গেছে, সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে সংবাদ সম্মেলন করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে আসেন আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর, ফারুক হাসানসহ কয়েকজন। এ সময় সেখানে আগ থেকে অবস্থান নেয়া ছাত্রলীগ নেতারাও গ্রন্থাগারের ভেতরে যাওয়া আসা শুরু করেন। গালাগালি করতে থাকে আন্দোলনকারীদের। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক এস এম জাবেদ আহমেদ তাদের উভয় পক্ষকে গ্রন্থাগারের সামনে থেকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। এরই মধ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা শুরু করে। ধাওয়া দিয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, কেন্দ্রীয় মসজিদ, নাটমণ্ডলের সামনে, হাকিম চত্বর, রাজু ভাস্কর্য এলাকায় মারধর করা হয় আন্দোলনকারীদের। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনেই বেধড়ক মারধর করা হয় আন্দোলনকারীদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূরকে। চতুর্মুখী কিল, ঘুষি, লাথিতে পড়ে যান নূর। সেখানে তাকে মারতে থাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বেধড়ক পিটুনিতে মুখ দিয়ে লালা বের হয় নূরের। এ সময় শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজার হাতে একটি চাপাতি দেখা যায়। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক জাবেদ আহমেদ নুরকে বাঁচাতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকেও লাঞ্ছিত করে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এ সময় প্রায় ৮ থেকে ১০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে নুরুল হক নূর ছাড়া অন্যরা হলেন- আতাউল্লাহ, আরিফ, মামুন, জসিম। বাকিদের নাম পাওয়া যায়নি।

এ দফায় মারধরকারীদের মধ্যে ছিল- কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান রনি, রুহুল আমিন, আদিত্য নন্দী, সাকিব হাসান সুইম (ঢাকা কলেজ), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নওশাদ সুজন, সাংগঠনিক সম্পাদক এন এইচ সওকতুর রহমান, দারুস সালাম শাকিল, কৃষি শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক বরকত হোসেন হাওলাদার, ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক ইয়াজ আল রিয়াদ, স্কুল বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, উপ-সম্পাদক মুরাদ হায়দার টিপু, মহসীন হলের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী, সূর্য সেন হলের সভাপতি গোলাম সরওয়ারের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মী। এ সময় ঢাকা কলেজেরও অনেক ছাত্রলীগ নেতাকে মারধরে অংশ নিতে দেখা যায়। প্রথম দফায় মারধরের পর দুপুর ১২টার দিকে ছাত্রলীগ গ্রন্থাগারের ভেতর থেকে আবারো কয়েকজনকে বের করে এনে মারধর করে। এদের মধ্যে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের আবাসিক ছাত্র মোহাম্মদ আরশকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘ধর ধর’ বলে মারতে থাকে। উপর্যুপরি কিল ঘুষিতে সংজ্ঞা হারান তিনি। এরপরও গ্রন্থাগারের সামনে সাইকেল রাখার পাকা স্ট্যান্ডে মাথা রেখে পায়ে চাপা দেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপ-সম্পাদক আল মামুন। পরে তাকে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। এরপর বেলা ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গেছে। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে তারিকুল ইসলাম নামে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের এক ছাত্রলীগ কর্মী। দেড়টার দিকে শাহবাগস্থ গণ গ্রন্থাগারের ভেতরে প্রবেশ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের খুঁজতে থাকে ছাত্রলীগ। এ সময় তারা গ্রন্থাগারের প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালায়। তালা লাগানোর চেষ্টা করে প্রধান ফটকগুলোতে। এতে গ্রন্থাগারে অধ্যয়নরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সন্দেহজনক মনে হলেই বাইরে টেনে এনে মারধর করতে থাকে। শুধু তাই নয় গ্রন্থাগারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদেরও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের খুঁজে দিতে বাধ্য করে ছাত্রলীগ। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক চলতে থাকা এ হামলায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ৫-৬ জনকে বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আহতদের মধ্যে জসীম উদ্দিন আকাশ নামে একজনের অবস্থা গুরুতর। আহত অবস্থায় তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হলে পুলিশ তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

এ হামলায় নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিদার মুহাম্মদ নিজামুল ইসলাম, সহ-সভাপতি রুহুল আমিন, কৃষি শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক বরকত হোসেন হাওলাদার, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপ-সম্পাদক আল মামুন, প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, এস এম হলের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল, বিজয় একাত্তর হলের সাবেক সভাপতি শেখ ইনানসহ ছাত্রলীগের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, ‘বেলা ১১টার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর পিস্তল ও রামদা নিয়ে হামলা চালায়। আমরা তাদের কাছে এটা প্রত্যাশা করিনি। এতে আমাদের অনেকে আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে নুর, আরশ, জসীমসহ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। এ ঘটনার প্রতিবাদে আগামীকাল থেকে দেশের সকল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করবে শিক্ষার্থীরা। অবরোধ করা হবে সারা দেশ।’ তবে এ হামলায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘এটা কোটার আন্দোলনকারীদের অভ্যন্তরীণ ঝামেলা। তারা দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এটার সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’ সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্যু না। লাইব্রেরিকে অবরোধ করেছে আন্দোলনকারীরা। শুক্র ও শনিবার ক্যাম্পাস বন্ধ থাকে। কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থাপনায় লাইব্রেরি খোলা থাকে। কিন্তু আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করছে একটি গোষ্ঠী। তারা সেখানে হাতাহাতি করেছে। তখন প্রক্টরিয়াল টিম অনেককে হাসপাতালে নিয়েছে চিকিৎসার জন্য।

সুত্র: মানবজমিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here