শুক্রবার থেকে টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হচ্ছে তাবলিগ জামাতের চার দিনব্যাপি ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন। আসছেন বিদেশী মুসল্লিরাও। এবারের বিশ্ব ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আর ইজতেমা শুরুর দিন শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে ইজতেমা মাঠে বৃহত্তম জুমআর নামাজ। জুমআর নামাজে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলার লাখো মুসল্লি শরীক হবেন।

ইজতেমায় যোগ দিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাবলিগ জামাতের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা জামাতভূক্ত হয়ে ইজতেমা ময়দানে আসছেন। কেউ বাসে, কেউ ট্রাকে, কেউবা রিকশায়, লঞ্চে চড়ে ইজতেমাস্থলে আসছেন। পরে গাড়ি থেকে নেমে নিজের মালপত্র নিয়ে ময়দানে গিয়ে নিজ নিজ জেলা ভিত্তিক খিত্তায় গিয়ে অবস্থান নিচ্ছেন।

ইজতেমা সংশ্লিষ্ট আয়োজকরা জানান, আল্লাহর অশেষ রহমতে সভাপতিহীন বিশ্বইজতেমার এতো বড় আয়োজন প্রতিবছরই অত্যন্ত সু-শৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা হয়। এজন্য আমাদের কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। পুরো ইজতেমা ময়দানকে মুরুব্বীদের পরামর্শে সাজানো হয়েছে। ময়দানে জেলাওয়ারি মুসল্লিদের অবস্থান, রান্না-বান্না করার স্থান, টয়লেট, অজুখানা, গোসলখানা সবই সুনিদিষ্ট করা থাকে।

এবারই প্রথম বারের-মতো বিশ^ ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে চার দিনের। পৃথক ভাবে পরিচানা করবেন বিবাদমান তাবলীগের দুই পক্ষ। আগামী কাল শনিবার দুপুরের আগে আখেরী মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে এক পক্ষের (মাওলানা জুবায়ের) পরিচালনায় ইজতেমা। তারা ইজতেমা ময়দান বুঝিয়ে দিবেন দ্বিতীয় পক্ষের (সাদ্পন্থী) কাছে। তাদের পরিচালনায় ইজতেমা শুরু হবে রবিবার ভোরে। সোমবার আখেরী মোনাজাতের মধ্যদিয়ে ইজতেমা সমাপ্ত হবে। ইজতেমা শেষে ময়দানে মুসল্লীদের ব্যক্তিগত মালছামানা ছাড়া বাকি সকল মালামাল স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বে থাকবে। মাওলানা জোবায়ের অনুসারী বিদেশী মেহমানরা দুইদিন ইজতেমা শেষে উত্তরা হাজী ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। ইজতেমা চলাকালীন উভয় পক্ষের তাবলীগ অনুসারী মুসল্লীরা টঙ্গীর আশপাশ এলাকার মসজিদে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবেন।

৫৪তম বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের যাতায়তের জন্য ১৩৮টি বিশেষ ট্রেন, ৪০০টি বিআরটিসি বাস, পর্যাপ্ত লঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হবে। এ জন্য ৯ হাজার পুলিশ, দুই শতাধিক র‌্যাব, ৩ শতাধিক আনসার, ২৮০জন ফায়ার সার্ভিস কর্মী নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবি প্রস্তুত থাকবে। দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ইজতেমা মাঠে মোতায়েন থাকবে। এতে প্রায় ১০ হাজার আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য পরো ইজতেমা মাঠ নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখবে। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চলাচলের জন্য ১৭টি প্রবেশ পথে আর্চওয়ে বসানো হবে। থাকবে ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার। আকাশপথে কয়েকটি হেলিকপ্টার নিয়মিত টহল দিবে। এছাড়া সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মুসুল্লীদের যাতায়তের জন্য তুরাগে ৭টি ভাসমান ব্রীজ নির্মান করা হয়েছে। তুরাগে নৌটহল ছাড়াও ডুবুরীদল মোতায়েন থাকবে।

এবারের বিশ্ব ইজতেমা রাজধানী ঢাকাসহ ৬৪ জেলার মুসুল্লিরা অংশ নিচ্ছেন। মুসল্লিদের জন্য ইজতেমা ময়দানকে জেলাওয়ারী ৫০টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। মুসল্লিরা খিত্তাওয়ারী যেভাবে অবস্থান নেবেন তা হলো, ১নং খিত্তায় গাজীপুর, ২, ৩ ও ৪ নং খিত্তায় টঙ্গী, ৫ ও ৬ নং খিত্তায় ঢাকার মিরপুর, ৭ ও ৮ নং খিত্তায় সাভার, ৯ নং খিত্তায় ঢাকার মোহাম্মদপুর, ১০ নং খিত্তায় ঢাকার ডেমরা, ১১ ও ১২ কেরানীগঞ্জ, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ ঢাকার কাকরাইল, ২০ নাটোর ও নওঁগা, ২১ ও ২২ রাজবাড়ি, ২৩ সিরাজগঞ্জ, ২৪ দোহার-নবাবগঞ্জ, ২৫ মানিকগঞ্জ, ২৩৬ টাঙ্গাইল, ২৭ রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধ লালমনিরহাট, ২৮ বগুড়া জয়পুরহাট, ২৯ মুন্সিগঞ্জ, ৩০ মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, ৩১ যশোর, ৩২ নারায়নগঞ্জ, ৩৩ বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ৩৪ ভোলা, ৩৫ নরসিংদী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ৩৬ কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ৩৭ ময়মনসিংহ, ৩৮ শেরপুর, জামালপুর, ৩৯ নেত্রকোনা, ৪০ কিশোরগঞ্জ, ৪১ গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, ৪২ মাদারিপুর, ৪৩ সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ৪৪ কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, ৪৫ ফেনী, নোয়াখালী, ল²ীপুর, ৪৬ কুমিল্লা, চাঁদপুর, ৪৭ পটুয়াখালী, ৪৮ বরগুনা, ৪৯ পাবনা এবং ৫০ দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়।

বৃহস্পতিবার দুপুরে ইজতেমা ময়দানে কথা হয় ঢাকার লালবাগ থানার সেলিম মিয়ার সাথে। তিনি জানান, তারা এলাকা থেকে ১৬ জনের একটি জামাতদল এসেছেন। তাদের এলাকার অপর জামাতের সাথীরা আগেই ইজতেমা মাঠে পৌঁছেছেন। তিনি বলেন- আল্লাহকে রাজি খুশি, নবীর দেখানো পথে এবং দীনের কাজ করতে এখানে এসেছি। মূলত আল্লাহ ও রসূলের সন্তুষ্ঠি লাভের জন্য ইজতেমায় তিনি এসেছেন বলে জানান।

বুধবার সন্ধ্যায় শহীদ আহসান উল্যাহ মাষ্টার স্টেডিয়ামে পুলিশের ব্রিফিং অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান। উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো: আজাদ মিয়া, ডিসি (ক্রাইম) শরিফুর রহমান, ডিসি (ট্রাফিক) আরিফুল হক ।

পুলিশ কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান সংবাদিকদের জানান, ইজতেমায় যে কোন ধরনের নাশকতা, নৈরাজ্য রোধে পুলিশ ও আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি প্রায় আট হাজার পুলিশ সদস্য ইজতেমায় দায়িত্ব পালন শুরু করছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক ময়দানের চারপাশে আইনশৃংখলা বাহিনী সতর্ক নজরদারি রেখেছে। সাদা পোশাকে মুসল্লিদের সঙ্গে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ইজতেমা সম্পন্নের জন্য তিনি সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

এদিকে ইজতেমা আগত মুসল্লিদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে অর্ধশতাধিক ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হার্মদদ , আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম, ইসলামি ফাউন্ডেশন, র‌্যাব, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন ইত্যাদি।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, মুসুল্লিদের নিরাপদ, বিশুদ্ধ খাবার ও আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে সমাধানের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন ৩০টি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হবে। মুসল্লিদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ফ্রি ওষধ সরবরাহ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করবেন। সারাবিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ থেকে মুসল্লিরা ইজতেমায় যোগ দেবেন বলে আশা করছেন তিনি। এ জন্য সরকারি ভাবে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, ইজতেমা চলাকালে বিশেষ ট্রেন চালু হবে এবং প্রতিটি ট্রেন টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে দুই মিনিট করে যাত্রা বিরতি করবে। বিদ্যুত কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ইজতেমা এলাকায় পাঁচটি ফিডারের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, এবছর ১৫টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ইজতেমায় আগত মুসুল্লীদের অজু-গোসলের জন্য প্রতিদিন প্রায় চার কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে। এছাড়া মুসুল্লীদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক টয়লেট ও গোসলখানা স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ৩০টি ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশক নিধনের ঔষধ স্প্রে করা হবে। ৫০টি গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে ইজতেমা ময়দান থেকে বর্জ অপসারণ, ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা ও ময়দান এলাকায় প্রয়োজনী বিøচিং পাউডার সরবরাহ করা হবে। এখানে বিদেশী ক্যাম্পে রান্নার জন্য ১৭৫টি গ্যাসের চুলা স্থাপন করা হয়েছে।

গাজীপুর সিভিল সার্জন ডা: সৈয়দ মঞ্জুরুল হক জানান, টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে বার্ণ ইউনিট, অর্থোপেডিক্স ও ট্রমা, চর্ম-যৌন সার্জারী, অ্যাজমা, কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞসহ ছাড়াও তাদের চারটি অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাস্থকর্মী ও অফিস সহায়ক ২৪ঘন্টা ডিউটি করবে। মুসল্লিদের সেবা দিতে ১৫টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here